মারিয়ানেলা – পর্ব ৭


বেনিতো পেরেস গালদোস (১৮৪৩—১৯২০) স্পেনের সর্বশ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের পাশে একইসঙ্গে উচ্চারিত হয় বেনিতো পেরেস গালদোসের নাম।ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক তিনি।তাঁর অন্যতম উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'ফোরতুনাতা এবং হাসিন্তা','জাতীয় ঘটনাক্রম'। 'মারিয়ানেলা', 'দন্যা পেরফেক্তা'' ইত্যাদি। বেনিতো পেরেস গালদোস জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৩ সালে গ্রেট কানারিয়া দ্বীপপুঞ্জের 'লাস পালমাস' নামক সুন্দর এক দ্বীপে।কর্ণেল পিতার মুখে স্পেনের স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শু্নে বড়ো হয়েছেন গালদোস।স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিক কাহিনির প্রতি তাঁর আগ্রহের সৃষ্টি হয় অতি অলপ বয়সে। ১৮৬২ সালে সাহিত্য এবং কলায় স্নাতক হওয়ার পর তিনি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রহসন-কবিতা, প্রবন্ধ এবং গল্প লিখতে থাকেন।্সেই সময় থেকেই চিত্রকলায় আগ্রহী হতে থাকেন।নাটকে বিশেষ আগ্রহ থাকায় তিনি মাদ্রিদে থাকাকালীন প্রায়শই নাটক দেখতে যেতেন।এই শহরেই স্পেনীয় লেখক লেওপোলদো আলাস ক্লারিন-এর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গালদোস ছিলেন লাজুক স্বভাবের, সহজ জীবন তাঁর ভালো লাগত,জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া পছন্দ ছিল না তাঁর, অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন লেখক, 'দন কিহোতে' উপন্যাসটির পাতার পর পাতা তিনি মুখস্থ বলে দিতে পারতেন।বালজাক এবং ডিকেন্স তাঁর প্রিয় লেখক।১৮৭৩ সালে শুরু করে চল্লিশ বছর ধরে চার খন্ডে 'জাতীয় ঘটনাবলি' রচনা করেন।ঊনবিংশতি শতাব্দীর স্পেনীয় জীবনের আলেখ্যটি মহান সাহিত্যকীর্তি হিসেবে গণ্য হয় এবং ইতিহাস-ভিত্তিক উপন্যাস রচনার ধারাটিকে পুষ্ট করে।বাস্তববাদী লেখক গালদোসের অন্যান্য রচনার মধ্যে আছে ৫১টি উপন্যাস,২৩টি নাটক এবং ২০টি খন্ডের অন্যবিধ রচনা।তিনি ছিলেন বহুপ্রজ লেখক। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় 'দন্যা পেরফেক্তা'(Dona Perfecta) অর্থাৎ 'শ্রীমতী পারফেক্ট'।এই উপন্যাসের মূল বিষয় মতাদর্শগত সংঘাত।১৮৮৯ সালে স্প্যানিশ রয়াল একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন গালদোস।জীবনের শেষ দিকে তিনি নাটক রচনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।স্পেনের অন্যতম সমকালীন লেখক পিও বারোহার(উচ্চারণভেদে বারোখার )মতে 'তিনি জানতেন মানুষকে কীভাবে কথা বলাতে হয়।' লোকজীবনের সাদামাঠা ভাষাই ছিল তাঁর পছন্দ, অলঙ্কারসমৃদ্ধ জমকালো বাক্য তিনি লিখতেন না। ১৯১২ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্যে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয় এবং স্পেনের সাহিত্যজগতে তুমুল আলোড়ণ ও্ঠে কিন্তু শেষপর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়।অসম্ভব জনপ্রিয় গদ্যকার বেনিতো পেরেস গালদোস ১৯২০ সালে মাদ্রিদে প্রয়াত হন। কুড়ি হাজারের বেশি মানুষ তাঁর অন্তেষ্টিতে অংশগ্রহণ করেন।

পর্ব-৭
আরও আবোলতাবোল
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর ওরা আবার চলতে শুরু করল, ‘সালদেওরো’ পেরিয়ে জঙ্গলের শুরু। আখরোট গাছের সারির মধ্যে এসে ওরা দাঁড়ায়, গাছগুলো যথেষ্ট পুরনো, ওদের শেকড় আর ঝুরি কয়েকটা সিঁড়ি তৈরি করেছে মাটিতে, মাঝে মাঝে শ্যাওলাধরা ফাঁকফোঁকর এবং ডাল বিছানো আছে, এমন সুন্দর বসার জায়গা আর হয় না। জঙ্গলে মাথায় পাহাড়, সেখান থেকে পাথর থেকে পাথরে লাফ দিয়ে নেমে এসেছে সুতোর মতো এক নদী, নীচে এসে জল জমে সরোবর সৃষ্টি হয়েছে, গ্রামের মানুষ
গেছে, উঠেছে সবুজ পাহাড়ের বিশাল পটভূমি, তার মধ্যেই জঙ্গল এবং বসতি, সমতলে মনের সুখে চরে বেড়াচ্ছে শত শত ভবঘুরে প্রাণী। দূরে দুটো টিলা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই মাটি শেষ, দেখা যাছে নীল সমুদ্রের দীর্ঘ প্রসারিত একটি অংশ। এমন এক নিসর্গ শোভার দিকে তাকালে আত্মার সঙ্গে অসীমের নিবিড় সংযোগ গড়ে ওঠে।
একটা আখরোট গাছের গুঁড়িতে বসে পাবলো, সরোবরের দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে বাঁহাত। তার কপাল স্পর্শ করেছে গাছের শাখা, সে ডান হাতটা উঁচু করে তা ধরে, এইভাবে কিছুক্ষণ থাকে, পাতা সরলে সূর্যের আলো এসে পড়ে।
–নেলা, কী করছ তুমি?
কিছুক্ষণ শোনা যায়নি কোনো শব্দ, না তার হাঁটাচলার শব্দ, না তার কন্ঠস্বর, কিংবা নিঃশ্বাসের শব্দ।
–কী করছ? কোথায় তুমি?
–এইতো এখানে— সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে নেলা উত্তর দিল— সমুদ্র দেখছিলাম।
–তাই? অনেক দূরে, না?
–‘ফিকোব্রিগা’র টিলা থেকে দেখা যায়।
–দারুণ, বিশাল, এত বিশাল যে সারাদিন চেয়ে থাকলেও দেখা শেষ হবে না। তাই না?
–এক টুকরোর বেশি দেখা সম্ভব নয়, তুমি পাঁউরুটিতে এক কামড় দিয়ে যা মুখে ভরো তার চেয়ে বেশি না।
–বুঝেছি। সবাই বলে যে, সমুদ্রের রূপের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনাই চলে না, তার মধ্যে যে সারল্য আছে তাতেই সে অনন্য।
–শোনো নেলা, একটা কথা বলব…কিন্তু তুমি এখন করছটা কী?
এখান থেকে জল তোলে। এর সামনের দিকে মাটি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে
দুহাতে আখরোট গাছের শাখা ধরে দোল খাচ্ছে নেলা।
–এখানেই আছি বন্ধু। ভাবছিলাম ঈশ্বর আমাদের কেন পাখির মতো উড়ে বেড়াবার পাখা দেন না? আকাশে ইচ্ছেমতো উড়তাম—ওঃ! ওই পাহাড়ের মাথায় ‘ফিকোব্রিগা’ আর সমুদ্রের মাঝে টিলার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে কতদূর চলে যেতে পারতাম…
–ঈশ্বর আমাদের পাখা দেননি ঠিকই তবে তার বদলে দিয়েছেন কল্পনা আর ভাবনা, তা সব পাখির চেয়ে বেশি উড়তে পারে, চলে যেতে পারে স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ পর্যন্ত… এবার বলোতো, ঈশ্বর ভাবনার বদলে পাখা দিলে আমি কী করতাম?
–তাহলে বলি, দুটোই আমি পেতে চাই। পাখা পেলে তোমাকে ঠোঁটে করে সব জায়গায় যেতাম আর তোমাকে মেঘেদের রাজ্যে পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারতাম।
অন্ধ ছেলে হাত বাড়িয়ে নেলার মাথা স্পর্শ করে।
–আমার পাশে বোসো। ক্লান্তি নেই তোমার?
–একটু— বন্ধুর পাশে বসে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে নেলা তার কাঁধে মাথা রাখে।
–নেলা, তুমি হাঁপাচ্ছ; খুবই ক্লান্ত তুমি। এত ওড়াওড়ি…।। তোমাকে আমি কী বলতে চাইছিলাম জানো? সমুদ্রের কথা বলে তুমি আমাকে একটা জিনিস মনে করিয়ে দিয়েছ, কাল রাতে বাবা ওটা পড়ে আমাকে শুনিয়েছেন। তুমি বোধহয় জান যে, বোধবুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকে আমার বাবা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ে শোনান, তার মধ্যে আছে বিজ্ঞান, ইতিয়াস,শিল্প এবং মজার গল্প। বাবা পড়েন, আমি মন দিয়ে শুনি। এই পড়া আর তোমার হাত ধরে বেড়ানো ছাড়া আমার জীবনে কিছুই নেই। দৃষ্টিহীনতা ইশ্বর পুষিয়ে দিয়েছেন স্মৃতিশক্তি দিয়ে আর সেই শক্তি পেয়েছি বলে পড়া থেকে আমার খুব উপকার হয়েছে, অবশ্য এসবের ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, সর্বোপরি যা শুনেছি এবং যতটুকু বুঝেছি তার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা রাখতে চেষ্টা করেছি। বিশ্বব্রম্ভান্ডের আশ্চর্য শৃঙ্খলার কথা জেনে কী আনন্দ যে পেয়েছি কী বলব, নক্ষত্ররাজির অবস্থান, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর অস্তিত্ব এবং তারপর মনোরাজ্যের নিয়মকানুন আরও বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এছাড়া ইতিহাসের কথা পড়ে আমি আনন্দ পেয়েছি, এতো মানুষের ভাঙ্গাগড়ার সত্যি গল্প। এইসব গল্প অতীত জীবনের, দেখা যায় মানুষ সবসময় একই অন্যায় অবিচার আর বোকামো করে এসেছে যদিও শুধরে নেবার চেষ্টাও চালিয়ে এসেছে মানুষ, কিন্তু কখনই নিখুঁত হতে পারে নি, ঈশ্বরই একমাত্র সর্বাঙ্গসুন্দর। শেষে বাবা আমাকে শুনিয়েছেন অনেক সূক্ষ্ম এবং গভীর বিষয় যা সহজে বোঝা যায় না, কিন্তু এসব ভেবে বেশ আনন্দ হয়, অবাক হয়ে ভাবতে হয়। বাবা বোঝেন না বলে এই পাঠ তাঁর ভালো লাগে না, মাঝে মাঝে আমারও এসব শুনে ক্লান্তিকর মনে হয়েছে, কিন্তু অন্য বিষয় থেকে মজা পেয়েছি। কোনো লেখক যখন সহজ করে লেখেন তখন বিষয়গুলো হয়ে যায় মণিমুক্তোর মতো মহার্ঘ। ওরা লেখেন কার্যকারণ এবং ফলশ্রুতির কথা, আমরা কী ভাবি, কেমন করে ভাবি এসব থাকে লেখায়, সবকিছুর সারবস্তু ওঁরা আমাদের শিখিয়ে দেন।
মনে হল যে, বন্ধু যা বলল তার একটি কথাও বুঝতে পারেনি নেলা কিন্তু হাঁ করে খুব মন দিয়ে সব শুনেছে। সবকিছুর নির্যাস আর কার্যকারণ সম্বন্ধে যা শুনল তার কিছু অংশ ধরার জন্যে মুখটা খোলার চেষ্টা করে, দেখে মনে হয় যে, উড়ন্ত মাছি ধরার জন্যে একটা পাখি মুখিয়ে আছে।
–আরও আছে— যুবক বলে— :
‘কাল রাতে বাবা আমাকে সৌন্দর্য সম্পর্কে কয়েক পাতা পড়ে শোনালেন। লেখক বলেছেন যে, সত্য এবং সততার আলো হল সৌন্দর্য, আরও অনেক মৌলিক ধারণা আছে, সবই শুনতে খুব ভালো লাগে।
–ওই বইটা— নেলা তার ভাবনা বোঝাবার জন্যে বলে— বোধহয় সেনতেনো- বাবার বইখানার মতো নয়, ওর নাম…’এক হাজার, না কত যেন, রাত’।
–বোকা মেয়ে,ওটা না; পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের কথা বলছিলেন…আদর্শ রূপ কী তা বুঝতে পারবে না? না, তুমি বুঝবে না…তোমার জেনে রাখা ভালো যে, একরকম সৌন্দর্য আছে যা চোখে দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, এমনকি কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারা তার ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়।
–যেমন, ধরা যাক, আমাদের ‘কুমারী মা’—নেলা বলে—তাঁকে আমরা দেখতে বা ছুঁতে পারি না, কারণ তাঁর ছবি কিংবা মূর্তি তিনি নন।
–একদম ঠিক বলেছ, কোনো ভুল নেই। এই বিষয়টা ভাবতে ভাবতে বাবা বইখানা বন্ধ করে রাখলেন, তিনি একটা কথা বলেন, আমি বলি আরেক। আকার নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম, বাবা শুনে বললেন:
-‘দুঃখের ব্যাপার হল যে, তুই সেটা বুঝতে পারছিস না। আমি সায় দিয়ে বললাম—:
–হ্যাঁ, একটিমাত্র সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছু নেই এবং তা সবার মঙ্গল সাধন করে।
এত সূক্ষ্ম বিষয়ে নেলা মন দিতে পারে না, বন্ধুর হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে সে রঙ মিলিয়ে সাজায়।
–এইসব বিষয়ে আমার নিজস্ব একটা ধারণা আছে— অন্ধ যুবক উদ্দীপ্ত হয়ে বলে–;
–কয়েক মাস ধরে এই ধারণাটি আমি মনেপ্রাণে লালন করেছি। হ্যাঁ, তাকে মাথার মধ্যে বহন করেছি, আমি তাকে বাঁচিয়ে রাখছি নিজের মাথায়…না, তার জন্যে আমার দৃষ্টির দরকার নেই, চোখ এখানে কোনো কাজে লাগে না। বাবাকে আমি বললাম:
–আমি এক আনন্দময় সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারি, এ এক রূপ যার মধ্যে সম্ভাব্য সব সৌন্দর্য ধরা পড়ে, তার নাম নেলা। আমার বাবা হাসতে হাসতে বললেন— ঠিক বলেছিস।
ক্রমশ…

তরুণকুমার ঘটক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ ভাষায় প্রাক্তন শিক্ষক ও হিস্পানিক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অনুবাদক। ‘দনকিহোতে’ এবং ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ সহ বিয়াল্লিশটি গ্রন্থের অনুবাদক। ‘দনকিহোতে’ লীলা রায় স্মারক পুরস্কার অর্জন করে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর অনুদিত গল্প কবিতা ছাড়াও প্রকাশিত হয় স্পেন ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ।
© All rights reserved by Torkito Tarjoni