মারিয়ানেলা পর্ব-৩


স্পেনের সর্বশ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের পাশে একইসঙ্গে উচ্চারিত হয় বেনিতো পেরেস গালদোসের নাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক তিনি। তাঁর অন্যতম উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ফোরতুনাতা এবং হাসিন্তা’,’জাতীয় ঘটনাক্রম’, ‘মারিয়ানেলা’, ‘দন্যা পেরফেক্তা’’ ইত্যাদি। বেনিতো পেরেস গালদোস জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৩ সালে গ্রেট কানারিয়া দ্বীপপুঞ্জের ‘লাস পালমাস’ নামক সুন্দর এক দ্বীপে। কর্নেল পিতার মুখে স্পেনের স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শুনে বড়ো হয়েছেন গালদোস। স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিক কাহিনির প্রতি তাঁর আগ্রহের সৃষ্টি হয় অতি অল্প বয়সে। ১৮৬২ সালে সাহিত্য এবং কলায় স্নাতক হওয়ার পর তিনি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রহসন-কবিতা, প্রবন্ধ এবং গল্প লিখতে থাকেন। সেই সময় থেকেই চিত্রকলায় আগ্রহী হতে থাকেন। নাটকে বিশেষ আগ্রহ থাকায় তিনি মাদ্রিদে থাকাকালীন প্রায়শই নাটক দেখতে যেতেন। এই শহরেই স্পেনীয় লেখক লেওপোলদো আলাস ক্লারিন-এর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গালদোস ছিলেন লাজুক স্বভাবের, সহজ জীবন তাঁর ভালো লাগত,জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া পছন্দ ছিল না তাঁর, অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন লেখক, ‘দন কিহোতে’ উপন্যাসটির পাতার পর পাতা তিনি মুখস্থ বলে দিতে পারতেন। বালজাক এবং ডিকেন্স তাঁর প্রিয় লেখক। ১৮৭৩ সালে শুরু করে চল্লিশ বছর ধরে চার খন্ডে ‘জাতীয় ঘটনাবলি’ রচনা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর স্পেনীয় জীবনের এই আলেখ্যটি মহান সাহিত্যকীর্তি হিসেবে গণ্য হয় এবং ইতিহাস-ভিত্তিক উপন্যাস রচনার ধারাটিকে পুষ্ট করে।বাস্তববাদী লেখক গালদোসের অন্যান্য রচনার মধ্যে আছে ৫১টি উপন্যাস,২৩টি নাটক এবং ২০টি খণ্ডের অন্যবিধ রচনা। তিনি ছিলেন বহুপ্রজ লেখক। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘দন্যা পেরফেক্তা’(Dona Perfecta) অর্থাৎ ‘শ্রীমতী পারফেক্ট’। এই উপন্যাসের মূল বিষয় মতাদর্শগত সংঘাত। ১৮৮৯ সালে স্প্যানিশ রয়্যাল একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন গালদোস। জীবনের শেষ দিকে তিনি নাটক রচনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। স্পেনের অন্যতম সমকালীন লেখক পিও বারোহার(উচ্চারণভেদে বারোখার )মতে ‘তিনি জানতেন মানুষকে কীভাবে কথা বলাতে হয়।‘ লোকজীবনের সাদামাঠা ভাষাই ছিল তাঁর পছন্দ, অলঙ্কারসমৃদ্ধ জমকালো বাক্য তিনি লিখতেন না। ১৯১২ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্যে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয় এবং স্পেনের সাহিত্যজগতে তুমুল আলোড়ন ওঠে কিন্তু শেষপর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়। অসম্ভব জনপ্রিয় গদ্যকার বেনিতো পেরেস গালদোস ১৯২০ সালে মাদ্রিদে প্রয়াত হন। কুড়ি হাজারের বেশি মানুষ তাঁর অন্ত্যেষ্টিতে অংশগ্রহণ করেন।

মারিয়ানেলা
পর্ব-৩
এক সংলাপ, এক উদ্ঘাটন
-ও মেয়ে দাঁড়াও একটু, অত দ্রুত হেঁটো না —গোলফিন একটু থেমে বলেন; – একটা সিগারেট ধরাতে দাও।
এত শান্ত রাত যে, সিগারেট জ্বালাবার জন্যে যে সাবধানতা দরকার হয় তা এখন লাগল না। সিগারেট ধরিয়ে দেশলাই কাঠিটা নেলার মুখের কাছে নিয়ে সবিনয়ে বললেন :
-দেখি, তোমার মুখটা দেখাও আমাকে।
অবাক হয়ে মেয়েটি তাঁর দিকে তাকায়, দেশলাইয়ের ক্ষণস্থায়ী আলোয় দেখা গেল আগুনের ফুলকির মতো দুটো কালো ডাগর চোখের অমলিন দৃষ্টি। কিশোরীই বলা যায় ওকে, রোগা শরীর, বাড় নেই যেন, বুকের গঠন ছোটো, কমবয়সি হলেও চোখের দৃষ্টি তত কাঁচা নয়, মুখে পরিণত মনের ছাপ, বিচারবুদ্ধি যথেষ্ট আছে বলেই মনে হয়। শরীরের গড়নে খামতি থাকা সত্ত্বেও আশ্চর্য পরিমিতি আছে, তার ছোটো মাথার মধ্যে এমন এক সপ্রতিভতা আছে যা শরীরের দুর্বলতা ঢেকে দেয়, কারও চোখে এ ছোটোখাটো এক নারী, কারও চোখে ভাবেভঙ্গিতে সে কিশোরী। তার সঙ্গে আলাপ না থাকলে সন্দেহ হতে পারে — সে কি আশ্চর্য এক এগিয়ে-থাকা মানুষ, কিংবা দুঃখজনকভাবে পিছিয়ে-পড়া !
-তোমার বয়স কত? —দেশলাইকাঠির আলো নিভিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে জিগ্যেস করলেন গোলফিন।
-লোকে বলে আমার বয়স ষোলো —ডাক্তারের দিকে চেয়ে উত্তর দেয় নেলা।
-ষোলো বছর! দেখে মনে হয় বড় জোর বারো। শরীরটা তেমন বাড়েনি।
-হা মা মেরি! লোকে বলে, আমি নাকি এক অসামান্য সৃষ্টি! —নিজের সম্পর্কে করুণা প্রকাশ পায় তার কথায়।
-অসামান্য সৃষ্টি! —মেয়েটির চুলের মধ্যে হাত দিয়ে ডাক্তার বলেন। হবে হয়তো! চলো, আমাকে রাস্তা দেখাও।
নেলা দৃঢ় পায়ে হাঁটা শুরু করল, কিন্তু বেশি এগিয়ে না গিয়ে ডাক্তারের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল, যাতে তিনি বুঝতে পারেন যে, সঙ্গী-গাইড যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে। খালি পায়ে হাঁটছে সে; ছোট্ট ব্যস্ত দুটো পা দেখে মনে হয়, এ মাটি, পাথর, জলাশয়, ঝোপঝাড় সব তার চেনা। সাধারণ একটা স্কার্ট পরেছে, তেমন লম্বা নয়, ন্যূনতম পোশাক সে পরেছে, ছোটো করে কাটা কোঁকড়া চুলের একটা গ্রাম্য সৌন্দর্য আছে, ভিখারির চেয়ে বেশি স্বাধীনতা আছে এই অসহায় কিশোরীর, কিন্তু তার বিনয়ী কথাবার্তার মধ্যে গোলফিন বুঝতে পারেন যে, এই মেয়েটির চরিত্র কড়া ধাতের এবং চিন্তাভাবনা বেশ ভালো। তার কন্ঠস্বরে ভদ্রতার প্রকাশ আছে, শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্যে নয়; তার চোখের চাহনি বহুদূরগামী, মাটি এবং আকাশ কোনোকিছুতেই তা আটকে নেই।
-বলতো আমাকে — গোলফিন জিগ্যেস করেন — তুমি খনিতে থাক? খনি-কর্মীর মেয়ে তুমি?
-লোকে বলে, আমার মাও নেই, বাবাও নেই।
-হায়! তুমি খনিতে কাজ করবে?
-না,সেন্যোর, আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না —মেয়েটি মাথা নীচু করে বলে।
-এ তো তোমার বিনয়।
তেওদোরো ওর মুখটা আবার একবার দেখার জন্যে ঝুঁকে তাকালেন। শুকনো মুখভর্তি ব্রণের দাগ, পাথুরে রাস্তায় ঘোরার ফলে মেখে ময়লা লেগেছে। কপালটা ছোটো, টিকালো নাকটা বশ সুন্দর, কালো চোখদুটো বেশ উজ্জ্বল, কিন্তু দৃষ্টিতে দুঃখী ভাব। মেয়েটির কালো কোঁকড়ানো চুল, কিন্তু খোলা হাওয়ায় রোদ আর ধুলোতে স্বাভাবিক রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। চাপা ঠোঁটে হাসি লেগে আছে কিন্তু সেই হাসি যেন স্পষ্ট দেখা যায় না, মরার আগে মানুষ স্বর্গের চিন্তা করার সময় যেমন হাসে এ হাসি তেমনই। রূপের বিচারে নেলার মুখ তেমন কিছু নয়, সুন্দর বলা যায় না, কিন্তু পোলো দে মেদিনার কাব্যের ভাষায় তার প্রশংসা অবশ্যই প্রাপ্য: “এমন সুন্দর মুখ ভিক্ষে চাইতে পারে না”। আসল কথা হল: ভিক্ষে করার মতো অবস্থায় নেমে গেলে মানুষের না থাকে কথা, না চাহনি, না হাসি।
গোলফিন তার মুখটা ধরে আদর করে, মোটা মোটা আঙুল ছুঁইয়ে যায় তার চিবুক, তার কপোল।
-বেচারা! —তিনি বলেন —ঈশ্বর তোমার প্রতি সদয় হননি। কার সঙ্গে থাক?
-সেন্যোর সেনতেনের সঙ্গে, খনির পশুপালক।
-আমার মনে হয়, প্রাচুর্যের সংসারে তোমার জন্ম হয়নি। কার মেয়ে তুমি?
-শুনেছি আমার মা বাজারে ক্যাপ্সিকাম বিক্রি করত। অবিবাহিতা মা। ‘মৃতদের দিনে’ আমাকে পেয়েছিল, পরে মাদ্রিদে আমাকে মানুষ করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল।
-মা কেমন ছিল কে জানে! —তেওদোরো বিড়বিড় করেন রাগে। –তোমার বাবার খবর বোধহয় কেউই রাখে না।
-হ্যাঁ সেন্যোর, -কিছুটা গর্ব সহকারে বলে নেলা —‘ভিইয়ামোহাদায়’ যারা আলো জ্বালিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রথম ছিল আমার বাবা।
-বাব্বা!
-বলতে চাইছি যে, মিউনিসিপ্যালিটি যখন প্রথম রাস্তায় আলো লাগায় —গল্পটায় ইতিহাসের গাম্ভীর্য মাখিয়ে সে বলে যেতে থাকে —আমার বাবার দায়িত্ব ছিল আলো জ্বালানো এবং পরিষ্কার করা। আমার মায়ের এক বোন আমাকে মানুষ করেছে, শুনেছি সেও ছিল অবিবাহিতা। আমার বাবার সঙ্গে তার গোলমাল হয় …লোকে বলে, সবাই একসঙ্গে থাকত …সবার এক হাঁড়ি …বাবা আলো লাগাবার কাজে যাবার সময় আমাকে একটা ঝুড়িতে বসিয়ে নিয়ে যেত, সেই ঝুড়িতে থাকত আলোর সরঞ্জাম …একদিন নাকি সেতুতে আলো পরিষ্কার করতে উঠছে এমন সময় আমি নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম।
-তুমি ডুবে গিয়েছিলে?
-না ডুবিনি, পাথরে আটকে গিয়েছিলাম। ‘কুমারী মায়ের’ দয়া। শুনেছি সেদিনের ঘটনার আগে পর্যন্ত আমি খুব সুন্দর ছিলাম।
-নিশ্চয়ই তুমি খুব সুন্দর ছিলে —ডাক্তারের মন দয়ার্দ্র হয়ে ওঠে। এখনও তাই আছো …কিন্তু আমি জানতে চাইছি , তুমি কি অনেকদিন খনিতে আছো?
-লোকে বলে, তিন বছর আগে এসেছি, নদী থেকে মা আমাকে তুলে এনেছিল, বাবার অসুখের সময় মা তার সেবা শুশ্রূষা করেনি, বাবা নাকি ভালো ছিল না, হাসপাতালে মারা গিয়েছিল। তারপর মা খনিতে কাজ করতে আসে। একদিন খনির মালিক মাকে তাড়িয়ে দিল, মা অনেকটা মদ গিলেছিল সেদিন…
-আর তোমার মা চলে গেলেন…
এতক্ষণে মহিলাকে আমার বেশ লাগছে। তিনি চলে গেলেন।
-মা ওই ওপরে এক গর্তের মধ্যে নেমেছিল —প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে নেলা বলে —মা ভেতরে ঢুকে আর বেরোতে পারেনি।
-যাঃ! শেষটা বড়ো দুঃখের।
-সেন্যোর, -খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে নেলা —ওর মধ্যে আমার মা আছে।
গোলফিন সস্নেহে মেয়েকে বললেন:
-ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর তুমি এখানে কাজে লেগেছ। খনির কাজ খুব কষ্টের। তোমার গায়ের রঙ হয়ে গেছে ধাতুর মতো, তোমার খাওয়াদাওয়া ভালো হয় না বলে তুমি এত রোগা। এই জীবন স্বাভাবিক শরীরের লাবণ্য খেয়ে ফেলে।
-না, সেন্যোর,আমি কাজ করি না। সবাই বলে, আমি অকর্মার ঢেঁকি, আমার দ্বারা কিছুই হবে না।
-আর বলতে হবে না, তুমি এক রত্ন।
-কী যে বলেন —নেলা বেশ জোর দিয়ে বলে —আমি কাজ করতে পারি না। একটা ছোটো বোঝা মাথায় চাপালে আমি মাটিতে পড়ে যাই। শক্ত কাজ করতে বললে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
-ঈশ্বর যা করেন …তবে আমি বলতে পারি, সঠিক লোকের হাতে পড়লে তুমি ভালো কাজ করতে পারবে।
-না সেন্যোর, -খুব জোরের সঙ্গে আবার বলে নেলা, যেন প্রশংসা করে বলছে, -আমি কাজের বাধা হয়ে দাঁড়াব, আমার দ্বারা কোনো কাজ হবে না।
-তার মানে তুমি ভ্যাগাবণ্ড?
-না সেন্যোর, পাবলোর সঙ্গী যে আমি।
-পাবলো কে?
-এক অন্ধ ছেলে, আপনার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল ‘ভয়ঙ্কর’ গ্রামে। দেড় বছর ধরে আমি তার সহায়। অন্ধের যষ্টি। সব জায়গায় ওকে নিয়ে যাই আমি; ঘুরতে ঘুরতে আমরা গ্রামের দিকে চলে যাই।
-আরে পাবলো তো খুব ভালো ছেলে।
ডাক্তারের দিকে চেয়ে নেলা আবার দাঁড়ায়। উৎসাহে তার মুখ আলোময় হয়ে ওঠে; চেঁচিয়ে ওঠে:
-মাথার ওপর ‘কুমারী মা’ আছেন। পৃথিবীর সেরা ছেলে সে। আমার হতভাগ্য মালিক। দৃষ্টিহীন হয়েও যারা চোখে দেখে তাদের চেয়েও সে ক্ষমতাবান।
-তোমার বন্ধুকে আমার ভালো লাগে। এখানকার ছেলে সে?
– হ্যাঁ সেন্যোর, দন ফ্রানসিস্কো পেনাগিলস-এর একমাত্র ছেলে, ভদ্রলোক যেমন ধনী তেমনই সৎ, ‘আলদেয়াকোর্বা’র সবচেয়ে ভালো মানুষ।
-এবার বলতো, তোমার নাম নেলা কেন? এর অর্থই বা কী?
মেয়েটা ঘাড় সোজা করে দাঁড়াল, তারপর একটু থেমে বলল:
-আমার মায়ের নাম ছিল মারিয়া কানেলা, কিন্তু সবাই তাকে বলত নেলা। লোকে বলে, এই নামটা মাদি কুকুরের। আমার নাম আসলে মারিয়া।
-আদরের মারিকিতা।
-আমার নাম মারিয়ানেলা, লোকে কানেলার মেয়ে বলেও ডাকে, আবার অনেকে বলে শুধু নেলা।
-মালিক বন্ধুটি তোমাকে খুব ভালোবাসে?
-হ্যাঁ সেন্যোর, খুব ভালো সে। বলে আমার চোখ দিয়ে সে দুনিয়া দেখে। আমি তাকে সব দেখাই। কোন জিনিস কেমন দেখতে তাও আমি বলি…
-যা কিছু সে দেখতে পায় না —বলেন ডাক্তার, ওর কথা শুনতে তাঁর ভালো লাগে।
-হ্যাঁ সেন্যোর, আমি সব ওকে বলি। সে জিগ্যেস করে তারা কেমন দেখতে আমি কথা দিয়ে ছবি এঁকে বোঝাই, এমন করে বলি যেন সে নিজের চোখে দেখতে পায়। ঘাস আর মেঘ, আকাশ, জল, বিদ্যুৎচমক, বাতাস মাপার যন্ত্র, প্রজাপতি, ধোঁয়া, শামুক, মানুষের শরীর এবং মুখ, জানোয়ারের চেহারা কেমন সব বুঝিয়ে দিই। কোনটা কুৎসিত, কোন জিনিস সুন্দর আমার মুখে শুনে সে বুঝে নেয়।
-তোমার কাজটা তো সোজা নয়। কুৎসিত আর সুন্দর! কিছুতেই কিছু নয়। ওসব নিয়ে তুমি ভাব? …পড়তে পার?
-না সেন্যোর,আমার দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়।
তার বলার ভঙ্গি এমন জোরালো যেন এই প্রতিবাদ বলতে চায়:
“আপনি সরল ভালো মানুষ বলে ভাবছেন যে, আমার কিছু দাম আছে”।
-তোমার ভাবতে ইচ্ছে করে না যে, ঈশ্বর তোমার মালিককে দৃষ্টিশক্তি দেবেন?
কোনো উত্তর দেয় না নেলা। পরে বলে:
-ঈশ্বর সর্বশক্তিমান! ওটা অসম্ভব।
-অসম্ভব নয়, অবশ্যই কঠিন।
-খনির এঞ্জিনিয়ার-ডাইরেক্টর আমার বন্ধুর বাবাকে আশা দিয়েছেন।
-দন কার্লোস গোলফিন?
-হ্যাঁ সেন্যোর, দন কার্লোস-এর এক ভাই চোখের ডাক্তার, লোকে বলে, অন্ধকেও সারিয়ে তোলেন তিনি, এক চোখে যারা দেখতে পায় না, ট্যারা চোখ সব তিনি সারাতে পারেন।
-এত ক্ষমতা তাঁর!
-হ্যাঁ সেন্যোর, সেই ভাই এখানে আসছেন খবর এসেছে, দাদা তাঁকে চিকিৎসার সবকিছু আনতে বলেছেন যাতে পাবলোর চোখ সারানো যায়।
-তিনি কি এসে গেছেন?
-না সেন্যোর, সবসময় আমেরিকা আর ইংল্যান্ডে তাঁকে যেতে হয়, এখানে আসতে দেরি হবে মনে হয়, কিন্তু এসব কথা শুনে পাবলো হাসে, বলে, ঈশ্বর জন্মের সময় যা কেড়ে নিয়েছেন তা কোনো মানুষ দিতে পারবে না।
-হয়তো ঠিকই বলেছে…আমরা কি কাছাকাছি এসে গেছি? …দেখছি চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, কালো ধোঁয়া যেন নরক থেকে উঠে আসছে, একটা কামারশালাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
-হ্যাঁ সেন্যোর, আমরা এসে গেছি। ওইসব বয়লার সারা দিনরাত জ্বলছে, সামনে ওয়াশিং-মেশিন, দিনেই শুধু চালু থাকে; ডানদিকে কামারশালা, ওই নীচে, সব শেষে অফিস।
প্রকৃতপক্ষে মারিয়ানেলা যেমন বলেছে গোলফিনের জায়গাটা তাই মনে হল। হাওয়া না থাকায় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে, ময়লা কালো ধোঁয়া বাড়িগুলো ঢেকে দিচ্ছে, চাঁদের আলোয় বাড়ির মাথাগুলো অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
এখানে থাকার আগেই দেখতে খুব ভালো লাগছে সবকিছু —গোলফিন দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেন —ধোঁয়ার মেঘে সবকিছু ঢেকে যাচ্ছে আর চাঁদের আলো তৈরি করেছে আবছায়া ডিস্ক, আর্দ্রতায় পরিপূর্ণ রাতের চাঁদ তো এমনই হয়। অফিস বাড়িগুলো কোথায়?
-ওইতো, এসে গেলাম বলে।
বয়লারের সামনে দিয়ে যাবার সময় গরমে দ্রুত পা চালিয়ে পার হয়ে যেতে হয়, ডাক্তার দেখতে পেলেন ধোঁয়ায় ঢাকা একটা বাড়ি। অন্য বাড়িগুলোও একই রকম। দেখা আর পিয়ানোর মিষ্টি বাজনা শোনা, খুব উৎসাহের সঙ্গে কে যেন একমনে বাজিয়ে চলেছে।
-মধুর সংগীত ; আমার ভাইয়ের বউয়ের হাতের বাজনা আমার চেনা।
-সেন্যোরা সোফিয়া বাজাচ্ছে —বলল মারিয়া।
বাড়ির জানালা দিয়ে ঘরের আনন্দ বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রধান ঝুলবারান্দাটা খোলা। ঘরের মধ্যে একটা ছোট্ট আলো দেখা যাচ্ছে: সিগারেট ধরিয়েছে কেউ। ডাক্তার পৌঁছবার আগেই আলোটা নিভে গেল, কিন্তু ফুলকিগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল: তার মানে, যে সিগারেট ধরিয়েছিল সে ওটা ছুঁড়ে দিল বাইরে।
-ওই তো চিরকালের ধূমপায়ী —আন্তরিক ভালোবাসায় চিৎকার করে ডাকলেন ডাক্তার:
-কার্লোস, কার্লোস!
-তেওদোরো! —ঝুলবারান্দা থেকে উত্তর উড়ে এল।
পিয়ানো থেমে গেল, গান গাওয়া পাখি চিৎকার শুনে যেন ভয় পেয়েছে। বাড়িটায় মানুষের চলাফেরার শব্দ। ডাক্তার গাইড-এর হাতে একটা রূপোর মুদ্রা দিলেন এবং দ্রুত দরজার কাছে চলে গেলেন।

তরুণ কুমার ঘটক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ ভাষায় প্রাক্তন শিক্ষক ও হিস্পানিক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অনুবাদক। ‘দন কিহোতে’ এবং ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ সহ বিয়াল্লিশটি গ্রন্থের অনুবাদক। ‘দন কিহোতে’ লীলা রায় স্মারক পুরস্কার অর্জন করে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর অনুদিত গল্প কবিতা ছাড়াও প্রকাশিত হয় স্পেন ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ।
© All rights reserved by Torkito Tarjoni
Pingback: মারিয়ানেলা পর্ব-২ – Torkito Tarjoni
খুব ভালো লাগছে, গল্পের টানে তরতর করে এগিয়ে চলেছি। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।