ইণ্টারভিউঃ বাস্তব চলচ্চিত্র একালের গল্প


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। কর্ম জীবন শুরু হয়েছিল অভিনয়ের হাত ধরে থিয়েটারে। ফটোগ্রাফি চর্চার প্রতি অদম্য ভালোবাসা ছিল ছোট বেলা থেকেই। কিন্তু এই চর্চাকে কখনোই জীবন জীবিকা হিসেবে দেখেনি বরং পরবর্তীতে অভিনয় থেকে কর্মজীবন প্রতিস্থাপিত হয়েছিল চিত্র পরিচালনায় এবং চিত্রনাট্য রচনায় দীর্ঘ ২০ বছর টেলি ছবি, ছোট ছবি এবং দৈনিক ধারাবাহিক পরিচালনার এবং সিনেমা চর্চার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত।
Reviewing ‘INTERVIEW’ by Mrinal Sen
মৃণাল সেন বুঝলেন এবং বোঝালেন আমার আপনার প্রত্যেকের পূর্ণ অধিকারে বাঁচবার নীতিই হলো সঠিক রাজনীতি এবং তা নিয়ন্ত্রিত করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের।
আপাতসত্য বা বাস্তব জীবনের সাধারণ উপস্থাপনাই শিল্পীর এক মাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। চলচ্চিত্রের মতো এতটা শক্তিশালী শিল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রে তো আরোই নয়। আইজেন্সটাইন এবং আঁদ্রে বাঁজার মতো বিপরীত মেরুর দুই চলচ্চিত্র শিল্প তাত্ত্বিক ও এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন নি। লেনিন উদ্ধৃতি দিয়েছে, ‘To us Cinema is most important of all arts’.
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের মতো মৃণাল সেনও নয়াবাস্তববাদী চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য যে শুধু চলচ্চিত্রে গল্প বলা নয়, উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। আমাদের নিজস্ব কল্পনা শক্তি ছাড়া যেমন একটা মহৎ সাহিত্যকে অনুভব করতে পারি না। সেখানে যখন চলচ্চিত্রে পরিচালক গল্প বলার জন্য তার দৃশ্য ও শব্দের সহায়তায় তৈরী ইমেজগুলো নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হয় তার প্রভাব অন্য যে কোন শিল্পের তুলনায় অনেক অপ্রতিরোধ্য। লুই বুনুয়েল নিজেই এই প্রসঙ্গের সমর্থনে ১৯৬৭ সালে বলেছিলেন ‘সিনেমার সাদা পর্দার ওপর যে আলো এসে পড়ে তা যদি নিখুঁত ভাবে বাস্তব সত্যকে উদ্ঘাটিত করত – তাহলে পৃথিবীটায় বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠতে পারত।‘
ষাটের দশকে জার্মানি, ইটালি, পোল্যান্ড, লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল ও আর্জেণ্টিনায় এক নতুন ধারার সিনেমার ভাষা সৃষ্টি হয়। ‘সিনেমা নোভা’ নাম দেওয়া হয়েছিল সেই নতুন ধরনের সিনেমাগুলোকে। এই ধারার বৈশিষ্ট্য শুধু মাত্র বাস্তববাদী চলচ্চিত্র নির্মাণেই নয়, স্পষ্ট রাজনৈতিক যা শ্রেণীসংগ্রামের একটা হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। এই নতুন বাস্তববাদী বিপ্লবী সিনেমা বাস্তববাদী বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার যে পদ্ধতি সেই পদ্ধতিটার জন্য সিনেমা শিল্প টাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে।
৬৯ সালে বানানো ‘ভুবন সোম’ থেকে মৃণাল সেন তার ছবিতে প্রতি মূহুর্তে সেই ভাবে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলেন। ওই সালেই রিলিজ করে ‘ইণ্টারভিউ’। বাংলায় ‘সিনেমা নোভার’ ভাষায় গল্প বলার একটা দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। বাংলায় ক্যাপাটিলজমকে পরাস্ত করে বাম জামানা শুরু হয়েছে। আর পাঁচ বছরের মধ্যে সেই রাজনীতির দর্শন ভেঙে টুকরো হতে দেখেছেন পরিচালক। ছবির বাস্তবতাকে বোঝানোর জন্য সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা উল্লেখ করেছেন কারণ তা না করলে নায়ক কে সব দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তার জীবনে সেই রাজনীতির প্রভাব কতটা পড়েছে সেটাও পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন সচেতন ভাবেই। ইতিপূর্বে তাঁর নির্মিত ছবির তুলনায় এই ছবিতে গল্প বলার ধরণ এবং তার আবহ নির্মাণে যে আমূল পরিবর্তন স্বাভাবিক ভাবেই দর্শকদের সেটা একটা বিপুল মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা দেয়। বিষয়গত ভাবে পরিবর্তন ছিল বলেই তার গঠন শৈলীও বদলে গিয়েছিল। বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে নান্দনিক প্রকাশভঙ্গির এতটা বদল হজম করতে পারেনি দর্শক।
প্রথমে ভুবন সোম তারপর ইণ্টারভিউ, শক থেরাপীর মত মস্তিষ্কে চলচ্চিত্রে বাস্তবতার সংজ্ঞা খুঁজতে শুরু করে। বাস্তবতার সংজ্ঞা কি এই প্রশ্ন তিনি নিজেই নিজের কাছে করেছেন, নিজেই উত্তর দিয়েছেন। ‘ সিনেমার বাস্তবতা তো অনেক পরে এমনিতেই বাস্তবতার কোন প্রকৃত সংজ্ঞা নেই। কার রিয়েলিটি ? আমার ? আপনার ? মাও সে তুঙের? নিকসন সাহেবের নাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ? অত্যন্ত আপেক্ষিক এই শব্দটা। কাজেই আমি যেহেতু আমাকে নিয়েই চিন্তিত, বিব্রত, আমাকে নিয়েই সব সময় রয়েছি তাই আমি কীভাবে রিঅ্যাক্ট করছি তার পরিবেশ তার আবহ অনুযায়ী সেটাই দেখতে হবে।‘
সাধারণ অর্থে ‘সিনেমা আর্ট’ দৃশ্য ও শব্দে একটা আবহ নির্মাণ করে দর্শকের চোখের সামনে একটা ইলিউশন তৈরী করা ছাড়া আর কিচ্ছু করে না এটা হতে পারে না। নিশ্চিত ভাবে ওই ইলিউশনের মধ্যে একটা নতুন পথের ইঙ্গিত থাকে এটা বিশ্বাস করতেন মৃণাল সেন। তাই কখনো কখনো একটা নির্জীব বস্তুও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে তার ছবির ইমেজে। আর কতটা প্রাণবন্ত সেটা ইণ্টাররভিউ-এর প্রথম শটেই বোঝা যায়। একটা কামানের মুখ আকাশের দিকে উঁচু করে আছে আর তার সঙ্গে গোলার আওয়াজ বুঝিয়ে দেয় যুদ্ধই যে কামানের প্রকৃত চরিত্র হোক না সে এখন নির্জীব। এর পরেই বিচ্ছিন্ন ভাবে পর পর আসতে শুরু করে কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাটের গথিক স্ট্রাকচার, কলকাতা শহরের রাস্তা থেকে ক্রেন দিয়ে উপড়ে নেওয়া ব্রিটিশ রাজপুরুষদের বিরাট বিরাট স্ট্যাচু। সাম্রাজ্যবাদের পতন হলেও তাদের শৌর্য যে ভীষণভাবে বর্তমান তা পরিষ্কার। এই ভাবেই একটা মন্তাজ দৃশ্য আর তার সঙ্গে বিক্ষিপ্ত ভাবে গোলার আওয়াজ। কিন্তু আরও নিবিড় একটা আনুভূতিকেও ওই গোলার আওয়াজের সঙ্গে জুড়ে দিলেন সঙ্গীতের মত। কানে ভোঁ লাগলে যেমন অনুভব হয়, কেমন যেন ঠাণ্ডা হিমশীতল তেমন একটা শব্দ, খুব মৃদু স্বরে সমান্তরাল ভাবে একনাগারে গেয়ে গেল যেন। মুহূর্তে সেই শব্দ থামে আর সেতারের ঝংকারে, কলকাতার মধ্যবিত্তদের মাথার ওপর দিয়ে ভেসে গেল স্বাধীনতার উল্লাস। একটা আশার স্বপ্ন যেন। এরপর এল চরিত্র লিপি। দর্শক প্রাথমিক একটা ধাক্কা কাটিয়ে থিতু হল। কিন্তু পরিচালক তো চাইছেন না দর্শকদের সুস্থির রাখতে। তাই যখনই ছবির নাম ওই ইণ্টারভিউ লেখা স্লেট টা দেখানো হলো ওমনি আবারও বেজে উঠলো যুদ্ধের দামামা। বাদ্যযন্ত্রের একটা ক্যাকোফোনিক বাস্তব পরিস্থিতিতে মানুষের জীবিকা নির্বাহের লড়াই এর চাপ কতটা বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু ক্ষণিকের সেই আওয়াজের পর আবার সেতারের সুরেলা ঝংকার যতই বাজুক দর্শক আর নির্ভেজাল মনোরঞ্জন পাবার জন্য যে এই ছবি দেখতে বসেনি পরিষ্কার বলে দিল পরিচালক। প্রথম থেকেই দৃশ্য এবং আবহ নির্মাণের এই বুনন মৃণাল সেনের সচেতন পরিকল্পিত মানসিক ধাক্কা, দর্শকের মাথায় একটা উত্তেজনা, শক থেরাপীর মত ইণ্টারভিউ-এর দর্শকের সামাজিক এবং রাজনৈতিক চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। এবং সেটা ক্রমে চেপে বসে যখন তারা শোনে একটা অদৃশ্য গলার আওয়াজ যে প্রশ্ন রাখছে চাকরির ইন্টারভিউ এর ঢঙে বারংবার। কিন্তু হঠাৎই কোন প্রস্তুতি ছাড়াই আর যত বার সেই প্রশ্নকর্তার মুখোমুখি হচ্ছে দর্শক ততবারই তাকে যেন এক অন্য ধরনের লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়তে হচ্ছে। তাদের মনে একটা কনফ্লিক্ট তৈরী করছে। সেই অদৃশ্য মানুষটার ইংরেজিতে করা প্রশ্ন আমাদের আরও একটা গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মুখোমুখি করছে। এই স্বাধীনতা আদপেই কি আমাদের ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে? যেখানে মাতৃভাষার স্বাধীনতা নেই জীবিকা যাপনে সেটা কিসের স্বাধীনতা ? স্বাভাবিকভাবেই গল্পের পরিবেশ রচনার এই ধরন মৃণাল সেনকে অন্য ধারার চলচ্চিত্রকার হিসেবে চিহ্নিত করে দিল।
শুধু ইন্টারভিউ ই নয় এরপরের আরো তিনটি ছবি (কলকাতা ৭১, পদাতিক, কোরাস) মিলিয়ে যে ‘কলকাতা ট্রিলজি’ মৃনাল সেন তৈরী করেন সেখানে গল্প বলার একটা নব্যতম ঢঙ খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। মূলধারার বাংলা সিনেমার পাশাপাশি সমান্তরাল নব্যবাস্তবধর্মী ছবি ইতিমধ্যে নিমাই ঘোষ, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরে শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই ১৯৫১ থেকেই। সেই হাত তারুণ্যে ভরপুর মৃণাল সেনও ধরেছিল ১৯৫৫ থেকে তার নিজের বোধ বুদ্ধি চেতনা অনুযায়ী। গল্প বলার যে চিরাচরিত ধরন, জীবনের থেকে উঁচুতে মাথা ঠেকানো নায়কের উপস্থিতিকে একেবারে ভেঙেচুরে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রে নতুন ন্যারেটিভ তৈরী হতে শুরু করলো ধারাবাহিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ছবির দৃশ্য, সংলাপ এবং আবহ রচনায় একটা বিশেষ ধরন বারংবার ব্যবহার করছেন তিনি। যেমন শার্প কাট, ফ্রিজ, সাদা পর্দার অতল থেকে উঠে আসা ইমেজ। অনেক সময়েই সরাসরি চরিত্রের মুখেই সেই সংলাপ ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন ইমেজ ব্যবহার করে দর্শককে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার একটা প্রয়াস চলতে থাকল।
অদৃশ্য রঞ্জিত মল্লিককে ইণ্টারভিউয়ে শেষ প্রশ্ন করা হয় ‘ মিঃ রঞ্জিত মল্লিক, ইউ সেইড ইউ রীড নভেলস – বিবর পড়েছেন ? বাই সমরেশ বোস ?’ রঞ্জিত মল্লিকের উত্তরের বদলে একটা শার্প কাট যেন বিবরের সন্ধানে মৃণাল সেন নিজেই নেমে পড়েন কলকাতার বুকে। ক্যামেরা দ্রুত ছুটে যায় কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু গলির মধ্যে দিয়ে। একটা স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে তৈরী হয় কেন পরিচালক এ ভাবে অলিতে গলিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ! কোন সে গহ্বর ? কোন সে ছিদ্রের সন্ধান ? এই রঞ্জিত মল্লিক কে? তারবাদ্য বেজে চলে। তার সেই অন্বেষণের মাঝেই শব্দের ধাক্কা অতি তীব্র হয়ে উঠে কী হবে বা কী হতে চলেছে এই সম্বন্ধে একটা ঔৎসুক্য তৈরী করে দেওয়াই পরিচালকের যেন উদ্দেশ্য।
মৃণাল সেন এর ‘ইণ্টারভিউ’ নিঃসন্দেহে বাংলা সিনেমায় নিয়ে এল এক দুঃসাহসিক পরিচয়। এই ছবিতে কাল্পনিক কোন সময়ের গল্প ছিল না। তৎকালীন শ্রেণীবিভক্ত মানুষের বাস্তবিক জীবনযাত্রা এবং রাজনৈতিক অভিঘাত থেকে তৈরী হওয়া মেট্রোপলিটান মানসিকতা ও তাদের বিদ্রোহের গল্প। এই ভাবে কোন রাজনৈতিক গল্প ইতিপূর্বে বাংলা ছবিতে দেখা যায়নি। এর আগে ছবিতে রাজনীতি থাকলেও ছবির নায়ককে অতিমানবীয় গুণে সমন্বিত করে তুলে তাকে কোন সামাজিক কর্মী, বা পার্টি নেতা বা শ্রমিক নেতার ভূমিকায় দেখা গেছে। যার সাফল্যের অধিকাংশই ছিল আবাস্তবোচিত ঘটনার সমাবেশে সংঘটিত। কিন্তু ইণ্টারভিউয়ের নায়ক একজন সাধারন মধ্যবিত্ত, লোভী, সুযোগ সন্ধানী, নিজের জীবন মান বাড়াতে সদা সচেষ্ট এক ব্যক্তি যে সামান্য প্রুফ রিডারের চাকরি করে। অন্য সাধারণ মানুষের মতোই জীবন যাপন করে। পিতৃবন্ধুর সুপারিশের জোরে নিজেকে আরো বিত্তশালী করতে চায় একটা স্যুট টাই পড়ে বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে যা তার জীবনে প্রেমের চেয়েও একটা সুখকর অনুভূতি এনে দেবে।
ইণ্টাররভিউ তাৎক্ষণিক বাস্তব এবং মানসিক ঘটনার অভিঘাতে তৈরী হওয়া মুহূর্তকে নিয়ে পর পর সাজানো একটা দিনের কোলাজ। বিদেশী অফিসে ইণ্টারভিউ দেবার জন্য নায়কের একটা স্যুট প্যাণ্ট টাই চামড়ার জুতো চাই। সবই আছে, মানে ছিল…পুরোনো তরঙ্গে বাড়ির অপাংক্তেয় জমিয়ে রাখা হরেক জিনিসের মাঝে চাপা পড়ে, টাই ছিল পুরনো একটা তার বাবার ব্যবহৃত, মোজা জোগাড় করেছিল বন্ধুর থেকে আর যে স্যুটটা পড়ে ইণ্টারভিউটা দিতে যাবার কথা সেটাও একটা বড় লণ্ড্রিতে ধুতে দেওয়া ছিল। আর সেখানেই মূল সমস্যা। ওই দিনই লণ্ড্রি ওয়ার্কাররা ডাকল হরতাল। ফলে দোকান থেকে জিনিস পাওয়া গেল না। তবে কি নায়কের আর ইণ্টারভিউ দিতে যাওয়া হবে না! এর ফলশ্রুতিতে নায়ক সারাদিন নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করে সে এক বিচিত্র সাম্রাজ্যবাদের তকমা পড়া কাঠামোর বিরাটা সমাজ ব্যবস্থার ক্রীড়নক হয়ে বেঁচে আছে। সেখান থেকে তার মনে একটা জিজ্ঞাসার জন্ম হয়। সেই জিজ্ঞাসা তাকে সেই আবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে বলে। তার সচেতন মন এবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
তবে সেই কোলাজ বিক্ষিপ্ত উদ্দেশ্যহীন নিরপেক্ষ নয় খুবই সচেতন আধুনিক চলচ্চিত্র ভাষার প্রকাশ। চাকরিটা পেয়ে যাবে এতটাই আত্মবিশ্বাসী নায়ক রঞ্জিত মাকে বলছে – “ভিতরে ভিতরে কেসটাকে এমন করে সাজিয়েছে না শেখর কাকা – ইণ্টারভিউটা জাস্ট এ ম্যাটার অফ ফর্মালিটি। মা – আরে বলই না একবার মাইনেটা কত ? মা মেঝে পরিষ্কার করতে করতে মুখ তুলে বলে – এখন যা পাচ্ছিস তার ডবল হল তো! উত্তরে রঞ্জিত আত্মবিশ্বাসের শিখরে পৌঁছে বলে – মোটেই না! তার চেয়েও বেশি ! প্লাস সামথিং প্লাস কমিশন … এরপরেই নায়কের ক্লোজ আপ শট, মুখে বলে – হিউজ।‘ এই হিউজ কথাটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পরিচালক শার্প কাটে চলে গেলেন বিরাট মাছের বাজারে যেখানে একটা মাছের মুণ্ডচ্ছেদন হচ্ছে। স্বাভাবিক একটা শক থেরাপীর মত দর্শক সচকিত হয়। এর ইমেজের সঙ্গে সেই সময় মধ্যবিত্ত বাঙালির সচ্ছল মাইনের একটা চাকরির রূপকল্পগত সাযুজ্য আছে। সেই সঙ্গে পরিমিত শব্দের ব্যবহার যা বাস্তবকে সমর্থন করে। তাকে বাড়তি প্রাধান্য দেবার জন্য কোন সঙ্গীতের প্রয়োজন নেই। এখানে সাধারণ মূল ধারার ছবির সঙ্গে একটা পার্থক্য আছে। ঘটনার অভিঘাতের মাত্রা বা চরিত্রের মানসিক অবস্থার সঙ্গে তার পরিবেশের সঙ্গে দর্শককে জোর করে যুক্ত করার জন্য যে ধরনের ড্রামাটিক মিউজিকের ব্যবহার হত মৃণাল সেন এই ছবিতে খুবই প্রয়োজনমত ব্যবহার করেছেন।
ট্রামের দৃশ্য যেখানে কোনটা বাস্তব আর কোনটা কাহিনীর অংশ সব একাকার হয়ে যায় তার দৃশ্য ও সংলাপের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। দর্শকের সঙ্গে নায়কের এবং তার পরিবারের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিচয়, নায়কের প্রেম, কলকাতার রাস্তা, বাড়ি, সিনেমার পোস্টার, জনগণ, ট্রাম-বাস-ট্যাক্সি-দোকানপাট ইত্যাদি ছোট ছোট দৃশ্যে দ্রুত গতিতে দর্শকের চোখের সামনে দিয়ে বইয়ে দিয়ে একটা সামগ্রিক সামাজিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরার যে আঙ্গিক মৃণাল সেন ব্যবহার করলেন সেটা সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনবত্ব বহন করে এনেছিল।
লণ্ড্রি শ্রমিক ধর্মঘটের জেরে নায়ক তার প্রার্থিত স্যুট টাই পেল না এমনকি বন্ধুর থেকে জোগাড় করা স্যুট টাইও হারিয়ে ফেলল, যেখান থেকে গল্পের নায়কের জীবনের নানান ঘটনা যা তার ব্যাক্তিস্তরে সামাজিক বিশ্বাসের প্রকাশ। স্যুট না পেয়ে সে ধুতি পাঞ্জাবি চটি পড়ে ইন্টারভিউ দিতে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই তার চাকরি হল না। ঔপনিবেশিকতার প্রতি তার আত্মসমর্পণ ছিল না। আজ্ঞাবাহক দাস হতে পারেনি সে। এটাই এই চাকরি না পাওয়ার মূখ্য কারণ। চাকরিটা না পেয়ে যথারীতি মুষড়ে পড়েছিল। কিন্তু পরে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে – সে তো একেবারে অভুক্ত নয়, একেবারে বেকারও নয়… কোলকাতায় এত লক্ষ লক্ষ লোক তো ভালো চাকরি না পেয়েও জীবন চালাচ্ছে। নায়ক যখন নৈশ নিঃশব্দতায় কলকাতার জনহীন পথে হাঁটছে তাকে অন্ধকারে দর্শকের প্রতিনিধি পরিচালক জানতে চায় সে কি মনমরা হয়নি? সে কি কাকাকে ধরে অসাধু উপায়ে একটা মোটা মাইনের চাকরি বাগাতে যায়নি ? এটা কি নৈতিক দিক দিয়ে ঠিক কাজ! নায়ক প্রথমে প্রশ্নকর্তাকে এড়াতে চাইল কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হল যে সে সুবিধেবাদী হয়ে উঠেছিল। এই সমস্ত দৃশ্যটির উপস্থাপনা খুবই কার্যকরী থিয়েট্রিকাল ভাবে দেখানো হয়েছিল তাত্ত্বিকরা যাকে ব্রেখটীয় পদ্ধতি বলে থাকেন। এখানেই নায়ক যে একজন সাধারণ মানুষ তাই বোঝান হয়েছে। তাই নায়ক রঞ্জিত মল্লিক সরাসরি দর্শকদের বলে দিয়েছিল ট্রামে যেতে যেতে যে সে আমার আপনার মতোই মানুষ যেখানে পরিচালক তাকে ক্যামেরা নিয়ে ফলো করছে।
অবশেষে পরিচালক দেখালেন তার ছবির নায়ক তার মূল শত্রুকে খুঁজে পেয়েছে। বুঝেছে স্বাধীনতার ২৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও ঔপনিবেশিকতা ভারতীয়দের ছেড়ে যায়নি। এখনো স্বাধীন ভারতে পাশ্চাত্য পোশাক ভাষা সভ্যতার মাপকাঠি। তাই রাতের অন্ধকারে দোকানে স্যুট টাই পড়া পুতুলের ওপর তার সব রাগ গিয়ে পড়ে। তার পোশাক ছিঁড়ে দিয়ে তাকে নগ্ন করে। আজকের সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে উলঙ্গ হয়ে পড়ছে এই দৃশ্য যেন তারই প্রতীক। সাদা চোখে মানুষের কাছে যেহেতু এই চিত্র ধরা পড়ে না তাই পরিচালক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নায়কের হাতে স্যুট টাই পড়া ম্যানিকুইনের বস্ত্র হরণ করে নগ্ন করার ইমেজ তৈরী করতে হয়েছে।
রাজনৈতিক ছবির একটা বিশেষ লক্ষণ হলো এই যে সেখানে সমস্যাগুলো যতই ব্যক্তির স্তর থেকে দেখানো হোক না কেন তার একটা সামাজিক রাজনৈতিক চেহারা থাকবেই। ইণ্টারভিউয়ে সবচেয়ে অর্থবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ হল ছবির শেষ অংশ। এখানে পরিচালক দর্শকের প্রতিনিধি হয়ে নায়ককে সরাসরি নানান প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে। আর এই প্রশ্নগুলো অনুধাবন করলেই ছবির মূল সুর বুঝে নিতে কারোরই অসুবিধে হবে না। আমার আপনার প্রত্যকের মনেই যে প্রশ্নগুলো জেগে উঠছে বা উঠতে পারে তাই শুনতে পাই আমরা। নায়ক সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের মতোই চেয়েছিল তার জীবনের মান বাড়াতে, দু পয়সা বেশী রোজগার করে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে, কিন্তু ঘটনার অভিঘাতে ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তার ভুল ভাঙে। শ্রেণী বৈষম্য আর সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে চলা সমাজের প্রতি তার ঘৃণা জন্মায়। সেই ঘৃণা পরিণত হয় বিক্ষোভে। আর সেই বিক্ষোভের একটা চরম বহিঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে, নায়কের আত্মপক্ষ সমর্থনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় ইণ্টারভিউ।
ইণ্টাররভিউ দেখে এরকম ভাবার কোন কারণ নেই যে চলচ্চিত্রে গল্প বলার সাধারন রীতির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এখনো আমাদের বাইসাইকেল থিভস্-এর মত গল্প, পথের পাঁচালীর মত গল্প, কোমল গান্ধারের মত গল্পের প্রয়োজন আছে। কিন্তু নতুন বক্তব্য বিশেষ করে রাজনৈতিক ছবির জন্য – গল্প এবং তথ্যচিত্র – তার ব্যাখ্যা এবং নিবন্ধ সবটারই দরকার। গদার বলেছিলেন তিনি সিনেমায় প্রবন্ধ লিখতে চান।
মৃণাল সেন একজন কমিটেড শিল্পী। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই শুধু নয় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি পথিকৃৎ। চলচ্চিত্রে তাঁর এই পরীক্ষা নিরীক্ষা আমাদের লক্ষ্য করে যেতেই হবে।
© All rights reserved by Torkito Tarjoni
একটি কালজয়ী চলচ্চিত্রের এত স্বচ্ছ এবং অকৃত্তিম পর্যালোচনা পড়ে সত্যি সমৃদ্ধ হলাম অমিতাভ দা।
এই ইন্টারভিউ টা আমার আরো বেশি ভাল এইজন্য লাগলো কারণ আমার নিজের মনেও এমন অনেক কিছু আছে যেগুলো রুপোলি পর্দায় ফোটাতে চাই, মৃণাল সেন was a institute for us, তা বলে বাকিদের প্রতি আমর সমান সন্মান আছে, আমি খুবই সাধারন ঘরের ছেলে , আর আমার কিছু সাধারণ চাওয়া পাওয়া আছে, যেগুলো প্রকাশ হয়না সহজে, কিন্তু এই ব্যাক্তি দেখিয়েছেন কিভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা সম্ভব, কতটা বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলে হয়তো এরকম একজন হওয়া যায় তা জানিনা, কিন্তু উনি আমাদের মত অনেকের কথাই শুধু দেখিয়েছেন এবং বলতে সাহস জুগিয়েছেন।
অমিতাভ দা, স্যার, আপনি খুব ভালো থাকুন, আর এই লেখাটার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল আমার।।
ধন্যবাদ।।