লালন সাঁইএর স্বপ্ন – শক্তিনাথ ঝা

লালনের মানুষ নিঃসঙ্গ, একক সত্তা। তার জন্ম এবং মৃত্যু অনিবার্য ঘটনা। জীবনের প্রাকৃত ভোগসুখগুলি বিষয়-বিষ। এ জীবনপ্রবাহ ক্ষণভঙ্গবাদী রীতিতে সৃষ্টি এবং বিনাশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। পূর্বজ উপাদানগুলি বিনষ্ট হয়ে শূন্যে মিলায়। সব অনিত্য; সব শূন্য। চিত্ত বা মন যে জীবনকে অনুভব করে তা স্বপ্নের মতোই।
লালনের মতে, দেহের এক পরিচালক সত্তা আছে। তিনি দেহের দশকর্ম জ্ঞানেন্দ্রিয়, ষড়রিপু, মনবুদ্ধিকে চালিত করেন –
“বাজিকর পুতলা নাচায় কথা কহায় আপনি তারে
জীবদেহ সাঁই চালায় ফেরায় সেই প্রকারে”
–(লালন সাঁইএর গান, কবিতা পাক্ষিক,২০০৫, পদ নং ১৫৭)
দেহ কারখানায়নিঃশব্দের কুঁড়ে ঘর থেকে চেতনার, শব্দের উদ্ভব হয়। পরমাত্মা যখন জীবাত্মাকে হরণ করে, সাময়িক এ কালপর্বকে লোকে নিদ্রা বলে। আর যখন নিঃশব্দ শব্দকে গ্রাস করে, ভেঙে যায় ভবের খেলা,তখন সূচিত হয় মৃত্যু (পূর্বোক্ত, পদ নং ১১৪, ১৪০, ১৪১)। ঘুমে স্বপ্ন আসে। এ ঘুম কখনো অসচেতনতার প্রতীক। তখন ঘরের পৈতৃক ধন চোর চুরি করে (পদ নং ৮২)। অন্যত্র এ ঘুম এককেন্দ্রিক মনসংযোগের অন্য নাম। স্বপ্নে প্রার্থিতের সঙ্গে মিলন হয়, জেগে তাকে হারাতে হয়। স্বপ্নে গৌর দেখা দেন, চেতনে তিনি হারিয়ে যান (পদ নং ২৫, ২৭)।
লালনের সাধনায় ব্রহ্মচর্য রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভুবনে সর্বত্র বিপরীতগুণাদি যুগ্মভাবে অবস্থান করে। সন্তান জন্মদানের প্রবৃত্তিরসঙ্গে থাকে সুখার্থের নিবৃত্তি। কাম শুক্রক্ষয় ঘটিয়ে সন্তানের জন্মদিয়ে দেহমনের ক্ষয় ঘটিয়ে জরামরণকে ত্বরান্বিত করে। স্বভাব বা সহজাত প্রবৃত্তিগুলিকে সংশোধন করার বিরল ক্ষমতা আছে দেহমনের। পুত্রার্থের প্রবৃত্তিকে মানুষ সুখার্থের নিবৃত্তিতে, কামকে প্রেমে পরিণত করতে পারে। মনের শুদ্ধতা এবং যথার্থ অনুশীলনে ক্ষতিকর প্রবৃত্তিগুলিকে হিতকারী উপাদানে রূপান্তরিত করা যায়। এ বিষয়ে চিত্ত/মনের গুরুত্ব সর্বাধিক। মনের গুণে সাধক হয় মহাজন (পূর্বোক্ত, পদ নং ১৮২)। মনকে শুদ্ধ না করে; মালা জপে,নাম কীর্তনে, নারী বর্জনে সাধনা হয় না। বরং অবদমিত প্রবৃত্তি স্বপ্নে বিপরীতকাল প্রসব করে-
“কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলেতে যায় স্বপ্ন দোষ কি হয় না সেথায়
আপন মনের বাঘে যাহারে খায় কে ঠেকায় রে”
–(পূর্বোক্ত, পদ নং ৪০৯)
দেহে চিত্ত বা মন গুরুত্বপূর্ণ। যা এবং যাকে মানুষ চিন্তা করে, যার যেমন মনের ভাবনা, তা ভাবমূর্তি গ্রহণ করে জীবনে এবং স্বপ্নে। রাধাভাবে ভাবিত চৈতন্য ঘুমের মধ্যে রাধাকে স্বপ্নে দেখতেন। নিজেকে রাধা ভাবতে ভাবতেতিনি তার সামাজিক ও পুরুষপরিচয়কে বিস্মৃত হয়েছিলেন। কবিরাজ গোস্বামীর গ্রন্থের অন্ত্যলীলায় এ সব তথ্য পাই। (পূর্বোক্ত, পদ নং ২৭৪, ২৭৭)। অনিত্য এবং অনাত্ম সত্য। আমি এবং আমার বোধে আমরা অনিত্য সংসার এবং মায়িক সম্পর্কগুলিকে নিত্য ভেবে প্রবঞ্চিত হই। কিন্তু জীবন দেবদুর্লভ। দেহ ছাড়া হয় না মুক্তি,হয় না মহাসুখের আস্বাদন। দেহী জানতে পারে তার মনের মানুষ সাঁইকে। দেহমনকে কেবা চালায়, কে চলে ফেরে, কে জাগে কে ঘুমায়- জানতে চান লালন (পূর্বোক্ত, পদ নং ৩০৬)। লালন অনুভব করেন যে দেহঘরে ঘর বেঁধেছেন ঘরামি, সাঁই, মনের মানুষ। সেখানে ‘কেবা ঘুমায়, কেবা জাগে, কেবা কার দেখায় স্বপন’(পূর্বোক্ত, পদ নং ৪২৬)বাহ্যতঃ সেখানে বহু সত্তা। কিন্তু তিনি মনের বহুস্তরের কথা বললেন না। বললেন,
“আপনি ঘুমায় আপনি জাগে আপনি লোটে সম্পত্তি
গগনের চাঁদ গগনে রয় ঘটে পটে হয় জ্যোতির্ময়”
-(পূর্বোক্ত, পদ নং ৪২৭)
এক অনন্ত রূপে প্রাদুর্ভূত হয়ে জগতে,জীবনে, স্বপ্নে লীলা করে চলেছেন। সেখানে কু, সু, মন্দভালোর বিভাগ অনর্থক।

শক্তিনাথ ঝা : বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক। কলিকাতা, কল্যাণী ও নেতাজি মুক্তবিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক। লোকধর্ম, লোকসমাজ, বাউল ফকির সংস্কৃতি এবং এক কথায় সামগ্রিক লোকসংস্কৃতি নিয়ে নিবিড় নিখুঁত ক্ষেত্রসমীক্ষা তাঁর রচনাগুলোকে নিশ্চিত ভাবেই সমৃদ্ধ করেছে। এখনও করে চলেছে। ২০১০-এ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কোলকাতা থেকে পান বিশিষ্ট পুরস্কার। ২০১২-১৩-তে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন স্মৃতি পুরস্কারে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। বাংলা একাডেমি, ঢাকা থেকে তাঁকে বিশেষ ভাবে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। তাঁর বহু গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি হল- “ফকির লালন সাঁই দেশ কাল এবং শিল্প’ (১৯৯৫- ডিঙ লিট প্রাপ্ত রচনা), 'মুসলমান সমাজের বিয়ের গীত এবং গোপ বিয়ের গান’ (২য় সংস্করণ ২০০৭), শ্রমসঙ্গীত’ (২০০৩), ‘মাদক বনাম ধর্ম অর্থ সমাজ' (২০০৩), 'বাউল ফকির ধ্বংসের র মতো গ্রন্থ। ইতিবৃত্ত’ (২য় সংস্করণ ২০১৫), ‘লোক ধর্মের বাহান্ন বাজার তেপান্ন গলি’ (২০১৬) ইত্যাদি।
© All rights reserved by Torkito Tarjoni