মায়া – তুষারকান্তি রায়


আজ বাংলা সাহিত্যের একটি নিয়মিত নাম তুষারকান্তি রায়। কৈশোরে " আরশি " পত্রিকায় লিখে কবিতার জগতে এসেছেন তিনি। 'দেশ', 'কবিতা সম্মেলন' , 'কবিতা প্রতিমাসে', ' শহর', 'এই সময়' , 'কৃত্তিবাস' , 'নতুন কৃত্তিবাস' , 'আজকের সম্পূর্ণা' সহ বাংলার লিটল ম্যাগাজিনে লিখে তিনি সাহিত্যচর্চার মূল স্রোতে যুক্ত রয়েছেন। তার প্রকাশিত কবিতার বইগুলি হলো -- 'সৃজন তুমি লিখতে পারো না তো', 'আলাপী শিশির' , 'বাউলের বারোকথা' , 'অকাল কিশোর' , 'সন্ধ্যা তারার গন্ধ','কিউমুলোনিম্বাস' , ' শোনো রাধারানি' , 'অন্যরোদ' । প্রকাশিত উপন্যাস - 'দাহপুরুষ' ,' তীর্থংকর মল্লিনাথ'।
মায়া
‘ ওমা ! সে কি ! তাই ? এমা ! ’
রোহিণীর প্রতিক্রিয়া শুনে টগবগ করে ওঠে ইন্দিরা । হাঁটতে হাঁটতে খুব যে একটা পিছিয়ে পড়েছিলো তা কিন্তু নয় তবুও প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠে , ‘ হুঁ , তবে আর বলছি কি ? কোয়েশ্চেন পেপার থেকে চোখ তুলে দেখি ব্যাটা সৈকত রোহিণীর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে । যতবার আমি দেখেছি ততবার একই কাণ্ড । ’
ইন্দিরার কথা শুনে একযোগে হই হই করে উঠলো রিমা , সুদীপা , ঊর্মি , আর ছন্দা । চলমান হাসির ছটায় কেঁপে উঠলো লস্কর পাড়া লেন । হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়ে এসেছিলো রোহিণী। একটু হেসে উত্তরে বললো , ‘ তুই যদি সর্বক্ষণ ওকেই দেখলি তবে নিজে লিখলি কখন ? ’
‘ তুই শেষ অব্দি আমাকেই ঠুকলি ? ’
‘ থাম তো । এসব কথা রাখ । এখন চ’ । ’ বলে ইন্দিরার হাত টেনে এগিয়ে গেলো সুদীপা । ইন্সটিটিউটের মক টেস্ট শেষ করে বেরিয়ে আসা বন্ধুর দল ততক্ষণে বড় রাস্তায় । কোলাহলের মধ্যে থাকলেও রোহিণীর মাথায় সায়েন্স , কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স আর জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ঘুরপাক খাচ্ছিলো । খেয়াল করেনি কথায় কথায় সে আলাদা হয়ে পড়েছে । এদিকে ছয় বন্ধুর খুনসুটি যেন থামতেই চায় না । আসলে বাসে ওঠার আগের এই সময়টুকুতে তাদের যত কথা । একসঙ্গে এখানে ওখানে যাওয়া , সিনেমা কিংবা রেস্তোরাঁর প্রোগ্রাম ঠিক করা অথবা পরীক্ষার প্রিপারেশন ইত্যাদি নিয়েই তাদের যত আলোচনা । তারপর বাস এলে যে যার মতো বাড়ি ।
হঠাৎ বিরাট একটা আওয়াজ করে রোহিণীর মুখোমুখি প্রায় গায়ের উপর ব্রেক কষে দাঁড়ালো একটা বাইক । আরোহী ছেলেটি সরাসরি রোহিণীর দিকে তাকিয়ে । রোহিণী বোকার মতো চেয়ে থাকে । কাঁধে সাইডব্যাগ । চেরি রঙের সালোয়ার, উঁচু করে বাঁধা চুলের দু’চারটে বেরিয়ে এসে সামনের দিকে আকর্ষের মতো ঝুলছে , এদিক – ওদিক । রোহিণী তখন অপ্রস্তুত , কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটা মেয়ে – একদম ন্যাচারাল বিউটির উদাহরণ । ঘটনার আকস্মিকতায় ভীত – বাকরুদ্ধ । ছেলেটা জোরে ব্রেক না কষলে আর দেখতে হতো না । বোকার মতো তাকায় রোহিণী । শক্তহাতে বাইকের ব্রেক কষে বসে থাকা ছেলেটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে । নির্লিপ্ত চাহনি । হাতলে হেলমেট রাখা । প্রায় পাঁচ আট বা নয় হাইটের পেটানো চেহারায় রঙ যেন ফেটে বেরোচ্ছে । সারা মুখে হালকা গোলাপি আভা । গম্ভীর । ডিপ কালারের ফুলস্লিভে দারুন দেখাচ্ছে ছেলেটাকে । চোখে চোখ পড়তেই রোহিণী বললো , ‘ সরি । ’
বাকিরা যেন এতক্ষণে ধরে প্রাণ ফিরে পেলো । এবার সকলেই যে যার কায়দায় ‘ সরি ’ বলতে আরম্ভ করলে ছেলেটি মাথা ঝাঁকিয়ে ‘ ইটস্ ওকে ’ বলেই বাইকে স্টার্ট দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া । রোহিণীর মনে হলো বাইকটির স্পিড ষাট সত্তর থেকে শুরু করে বাড়তে বাড়তে নব্বুই হয়ে গেছে ।
* * * * * * * * *
রাতে ফ্রেশ মুডে পড়ার টেবিলে জিকের বই খুলে বসলো রোহিণী । চোখ বলাচ্ছিলো ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলোর উপর । হঠাৎ কানের কাছে বেজে উঠলো বাইকের ব্রেক কষে দাঁড়ানোর আওয়াজ । মনোযোগের তাল গেলো কেটে । চেষ্টা করলো পড়ায় মন দিতে । পাতা উল্টে চলে এলো ইতিহাসে । যুদ্ধ , সন্ধি , অধিবেশন দেখতে দেখতে মন চলে গেলো ইন্সটিটিউশন থেকে বড় রাস্তায় । একটি সুঠাম সুন্দর চেহারার মুখ নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে । মাথা ঝাঁকিয়ে রোহিণী মন দিলো বইতে । একসঙ্গে অনেকগুলো পাতা উল্টে পৌঁছালো ইন্টারন্যানাশাল রিলেশনস্ এ । তাতেও মন বসলো না । মাথার মধ্যে রিমঝিম করে বেজেই চলেছে — ‘ইটস্ ওকে’।
কিন্তু দোষ তো রোহিণীরই । ব্রেক কষার আওয়াজটা এতো বিকট ছিলো যে সহজেই তার বোঝা উচিৎ ছিলো – যথেষ্ট স্পিডে ছিলো বাইকটি । দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কি হতো ! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিলো তার । অথচ ছেলেটা দুটো বাজে কথাও বললো না । চোখ বুজে শুয়ে পড়লো রোহিণী । মনে মনে ছক কষলো কালকের দিনটার । কাল সকাল দশটায় ক্লাস । মক টেস্টও আছে । এই একজামগুলো অনেকটা কনফিডেন্স বাড়ায় । বই খুলে আর বসতে ইচ্ছে হলো না ।
সকালে উঠে মাকে তার কাজে একটু হেল্প করে রেডি হতে বেশ দেরিই হয়ে গেলো । ব্যস্ত হয়ে বেরুলো ইন্টিটিউটের উদ্দেশ্যে । রাস্তায় পৌঁছে চিৎকার করে ডাকলো , ‘ অটো ‘ ।
* * * * * * * * *
রোববারের বিকেল । গায়ে আলসেমি আর খানিকটা ক্লান্তি মেখে বিছানায় গড়াচ্ছিলো রোহিণী। আধো আলো ঘর । ফোন কানে বাবা এলেন । কথা বলছেন খুশি খুশি মুখে । মাথা নাড়ছেন । হাসছেন । মুখ থেকে ছিটকে ছিটকে বেরুছে খুশির প্রকাশ । ওপারের কিছু শোনা যাচ্ছে না । বাবা বলছেন , ‘ বাহ্ ! তাই ! গুড ! ভেরি গুড ! ওঃ ! হোয়াট’স অ্যাপে ছবি পাঠিয়েছিস ? । আচ্ছা , আচ্ছা , ভালো করেছিস । ঠিক আছে । আমি আজই কথা বলছি । ক’দিন পরেই জানাচ্ছি । ভালো থাকিস । পরে কথা হবে । এখন রাখছি । ’
কল এন্ড করে ফোন হাতে পাইচারি করতে করতে রোহিণীর বাবা রান্নাঘরের দিকে মুখ করে ডাকলেন , ‘ কলি ! একটু এঘরে আসবে ? ’
মা এলেন এক’পা দু’পা করে । হাতে একটা কাপ । ‘ কি বলছো ? ’
‘ তুইও শোন বাবা । ছায়া ফোন করেছিলো । তোর বিয়ের একটা যোগাযোগ হয়েছে । ছেলেটি এর মধ্যেই তোকে দেখেছে। আগেই নাকি ছায়ার বাড়িতে তোর ছবি দেখেছিলো । ছায়া বললো , ছেলেটি রাজপুত্রের মতো দেখতে । বিরাট ব্যবসায়ী । বাবা নেই । মাকে নিয়ে আসানসোলে থাকে । বরানগরে বিরাট একটা ফ্ল্যাট কিনেছে । ব্যবসার কাজে মাঝে মধ্যে এসে থাকে ।’
বাবা হাসছেন । মায়ের মুখেও হাসির ঝলক । ‘ ছবিও পাঠিয়েছে । ছায়া বললো । ’ বলতে বলতে বাবা ছায়া পিসিকে সার্চ করতে লাগলেন । মায়ের পিছন পিছন বাবাও বেরিয়ে গেলেন ওর ঘর থেকে । এই ছায়া পিসি রোহিণীর বাবার কলিগ অশোককাকুর বোন । আত্মীয়তা না থাকলেও ঘনিষ্ঠতা খুব । উভয় পরিবারই উভয়ের ওয়েল উইশার । ন’মাসে ছ’মাসে দেখা হলেও ফোনের বন্ধন খুব দৃঢ় ।
কিজানি কেন রোহিণীর বুকের ভিতর এক বিষাদ মাখা অন্ধকার নেমে এলো । আষাঢ়ের আকাশ বুঝি ভেঙে পড়েছে তার মাথায় । চড়া রোদের ঘেমো গরম আর ছিঁচকাঁদুনে বর্ষার মাঝখানে তার মনটা কেমন ছটফট করে ওঠে । টেবিলে এখন রাশি রাশি বই । বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ইন্ডিয়ান কন্স্টিটিউশন আর ইন্ডিয়ান ইকোনমির দিকে । এর মধ্যেও অসভ্য মাছির মতো কানের কাছে বনবন করছে , ‘ ইটস্ ওকে । ’ সুতরাং , বাবা –মায়ের খুশিতে একমত হতে পারছে না রোহিণী। কারণটা যদিও নিতান্তই ঠুনকো । তবে রোহিণীর নির্লিপ্ততা তাঁদের খুব ভাবিয়েছে বলে মনে হলো না ।
চা খেয়ে ঘরে এসে পড়ার টেবিলে বসলো রোহিণী । ফোনটা হাতে নিয়ে অনলাইন হলো । এই সময় একটু এফ বি করা তার অভ্যাস । আরে ! ছায়া পিসি তো তার হোয়াটস্ অ্যাপেও সেই রাজপুত্র পাত্রের ছবি পাঠিয়েছে । কী কাণ্ড ! যাই হোক , পাক খেতে খেতে ছবিটি পরিষ্কার হতেই তার বিদ্যুৎপৃষ্ঠ অবস্থা । বুকের ভেতর আধফোটা ইচ্ছেগুলো মাথা দোলাতে শুরু করলো । এবার মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়েই যাবে । একটা পজিটিভ ভাইব্রেশন মনে ধাক্কা মারছে । সারা শরীরে বয়ে যাচ্ছে এক্সাইটমেন্টের তরঙ্গ । এতো সেই , ‘ ইটস্ ওকে ! ’
* * * * * * * * *
ঝড়ের বেগে কেটে গেছে চার চারটি বছর । আসানসোল আর কোলকাতা করে প্রথম প্রথম দু’বছর কেটেছে । মাথা থেকে চাকরির ভুতটাও উধাও হয়ে গেছে রোহিণীর । মেয়েদের সেল্ফ কনফিডেন্স হওয়া বলতে যে আর্থিক স্বাধীনতার কথা সে বুঝতো সেটা এখন তার একটু বেশিই আছে । ইচ্ছেমতো খরচ করেও শেষ হয় না । তারপর এলো পুপুন । এতদিন একবারের জন্যও মনে হয়নি মিঃ বিউটিফুল মানে তার স্বামী দেবোত্তম রায়চৌধুরী আসলে কি কাজ করে । বিশাল বাড়ি , ফ্ল্যাট , গাড়ি , চাকর-বাকর , ইত্যাদির যে এলাহি খরচ তার উৎস নিয়ে কোনও প্রশ্ন জাগেনি রোহিণীর । কিন্তু এখন সেকথা ভাবতে হচ্ছে ।
এবার বরানগরের ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই শান্ত আর সুন্দর মানুষটিকে বড্ড অস্থির লাগছে । যদিও অধিকাংশ সময় দেবোত্তম কোলকাতায় একাই থাকে । শাশুড়ির চিকিৎসার জন্যই এবার একসঙ্গে এতদিন থাকা । মুখে প্রকাশ না করলেও তার স্বামীর আচরণে রোহিণী আন্দাজ করেছে মানুষটি বড় টেন্সড হয়ে আছে । হয়তো আগেও এমন হয়েছে তবে রোহিণী তেমনভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়নি ।
বরানগরের এই ফ্ল্যাটে বসার ঘরই তো দুটো । তার একটিতে সকলের অবারিত দ্বার । অন্যটি দেবোত্তমের একান্ত নিজস্ব। ঘরে থাকলে ওঘরেই তার দিনের অনেকটা সময় কাটে । কখনও কখনও দু’একজনের সঙ্গে দরজাআঁটা মিটিং ও চলে । তার একটি ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখেই অন্যটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন । রোহিণীর প্রয়োজন হয় না বলে অই ঘরে তার খুব একটা আনাগোনা নেই । এক-আধবার সেই ঘরে ঢুকে দেখেছে দেওয়ালের একদিকে খোলা র্যাক ভর্তি নানাধরনের বইতে ঠাসা । বাকি একদিকে দরজা দেওয়া কাঠের আলমারি । তালাবন্ধ । বাকিটা ডিজাইনার ফার্নিচারে সাজানো । আশাদি নিয়মিত ঝাড়পোছ করে ঝকঝকে করে রেখেছে ।
দেবোত্তমের মা পুপুনকে নিয়ে দক্ষিণের ব্যালকনিতে রয়েছেন । এই ফাঁকে রোহিণী চান করে শোবার ঘরে এলো । বিছানায় একগোছা চাবি পড়ে আছে । এই চাবির গোছাতো দেবুবাবুর বসার ঘরের কাঠের আলমারির । একমাত্র এই চাবির গোছাটি কখনোই হাতছাড়া করে না দেবুবাবু । এমনিতে কিছু চাবি দু’জনের কাছেই থাকে । আর কিছু দু’জনের আলাদা এবং ব্যক্তিগত । কাজের চাপে ভুল হয়ে গেছে নিশ্চয়ই । রোহিণী পরে থাকা চাবির গোছা নিয়ে দেবোত্তমের বসার ঘরের সেই আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালো । কোনও কারণ ছাড়াই বড় চাবিটি দিয়ে আলমারির পাল্লা খুলে তো সে অবাক । তাকে তাকে রাখা শার্ট-প্যান্ট ইত্যাদির সঙ্গে গোছা গোছা টাকার বান্ডিল । থরে থরে সাজানো । এইসব পোশাক দেবুকে কবে পরতে দেখেছে – মনে করতে পারলো না । আর টাকা ! এতো টাকা এলো কোত্থেকে ? কাঠের আলমারিতে লকার দেখে কৌতূহল হওয়ারই কথা । আন্দাজে চাবি হাতড়ে সেই লকার খুলে তো চক্ষু চড়কগাছ ! মদের বোতলের পাশে যত্ন করে রাখা আছে একটা নাইন এম এম , একটা কার্বাইন মেশিনগান আর একটা এস এল আর ।
* * * * * * * * * *
সেই বসার ঘর । মুখোমুখি বাপি আর রোহিনী । দেবুই রোহিণীকে বাপির ফোন নম্বর দিয়েছিলো । খুব প্রয়োজনে সাহায্যের জন্য । কখনো দরকার হয় নি । আজ সেই বাপি ডোরবেল বাজিয়ে রোহিণীকে অনুসরণ করে এসে বসেছে । ভুমিকা না করে শুরু করে রোহিণী , ‘ ক’দিন ধরে দেখছি তোমার গুরু খুব টেন্সড্ হয়ে আছেন । কারণটা বলবে ? ’
প্রথমটায় বাপি ওরফে বুম্বা সামান্য ইতঃস্তত করলেও সত্যি বলতে সময় নেয় না । বাপির ধারণা বৌদি নিশ্চয়ই এতদিনে তাঁর স্বামীর বিষয় জেনে গেছেন । প্রাণ খুলে সব গোপনকথা শেয়ার করে । রোহিণী চমকে উঠলেও মনে মনে মিলিয়ে নিতে থাকে । অবাক হয়ে শোনে , মানুষ খুন ছাড়া অন্য কোনও কাজে তার স্বামীর আগ্রহ নেই । তোলা আদায় বা বোমাবাজির মতো ছোটো কাজ বাপি ওরফে বুম্বার গুরু পছন্দ করে না । সে আজ পর্যন্ত কোনও কাজে বিফল হয়নি । এমন কি পছন্দের মেয়ে রোহিণীকেও জীবনসঙ্গী করতে চমক দিতে পিছপা হয়নি তার গুরু । তাদের লাইনে তার গুরুর হাইরেট । তাদের মধ্যে কাজের সব কথাবার্তা হয় কোড ল্যাঙ্গুয়েজে । এই লাইনে তার গুরু রকি নামেই পরিচিত । বেশ কিছুদিন বুম্বা রকির শিষ্য হয়েছে । গুরুর দেওয়া বিদ্যা সে পুরোই রপ্ত করেছে । ইতিমধ্যে বুম্বা গুরুর হয়ে চারজনকে শুট করেছে । অভ্রান্ত নিশানা । রকির মতোই ।
গুরু যখন একা ছিলেন তখন এই ঘরের এই সোফাতে বসেই বুম্বা রিভলভার , মেশিনগান , ওয়ান শটার নিয়ে থিয়োরি শিখেছে । ফিল্ডে গিয়ে হাতে-কলমে শিক্ষাও নিয়েছে । তার গুরু এখন খুব চিন্তায় আছে । ক’দিন ধরে নীলুদা হেব্বি জ্বালাচ্ছে । পাঁচু মাস্টার আর ওর বাচ্চাটাকে ফুলস্টপ দেওয়ার দায়িত্ব তাই গুরু তাকেই দিয়েছে । রোহিণীর ভাবতে অবাক লাগে – এই সুন্দর মানুষটির ভেতরে একটি এমন হিংস্র সুপারি কিলার লুকিয়ে থাকতে পারে ! আর চার চারটি বছর ঘর করেও সে তার নাগাল পায় নি ! মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে । ওর কলেই ওকে উচিৎ শিক্ষা দেবে । এমনিতেও ওই মানুষটির সঙ্গে থাকা অসম্ভব । বুম্বার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে , ‘ তোমার ওই কাজের ডেট ফিক্সড্ হয়েছে ? ’
‘ দু’চার দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে । ফিল্ড ওয়ার্ক কমপ্লিট । কেন? বৌদি ?’
বুম্বা ওকে বৌদি বলছে – ঘেন্নায় শরীর অবশ হয়ে এলো রোহিণীর । তবুও শান্ত গলায় বললো , ‘ তার আগে আমার একটা কাজ নামাতে হবে বুম্বা । একটা টেটিয়া মহিলা আর তার বাচ্চাটাকে তিন সের চটকা দিতে হবে । তোমার তিন পাত্তিতে হবে না ? তুমি রাজি থাকলে কাল ভোরেই হয়ে যাক । যত তাড়াতাড়ি বিদেয় হয় ততই ভালো । কথায় বলে শত্রুর শেষ রাখতে নেই । আর , হ্যাঁ , তোমার দাদাকে কিন্তু এর বিন্দু বিসর্গ জানাবে না । সময় এলে ঠিক জেনে যাবে । ’
রোহিণীর কথায় বুম্বা চমকে ওঠে । ঘরোয়া বৌদি যে তাদের ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলছে । একটু আগে কথায় কথায় যে সে নিজেই এই কোডগুলো ব্যবহার করেছে – ঘটনার আকস্মিকতায় সেটাও ভুলে গেলো । কেবল ঢোক গিলে মুচকি হাসার চেষ্টা করে বললো , ‘ কী যে বলছেন বৌদি । ’
বৌদি ডাকটা শুনে সাড়াটা গা জ্বলে উঠলো রোহিণীর । মুখে বললো , ‘ সিরিয়াসলি বুম্বা । অ্যাডভান্স পেমেন্ট । ফুল । ফিল্ড ওয়ার্ক আমার করাই আছে । কাল ভোরেই হয়ে যাক । ’
কথা শেষ করেই রোহিণী টেবিলে পাঁচ লাখ টাকার একটা বান্ডিল রাখে । বুম্বা অবাক চোখে তাকায় । গলা খাঁকারি দিয়ে বলে , ‘ স্পটটা ? ’
‘ ঠিক ওলাইচণ্ডীতলা মন্দিরের পিছনের রাস্তায়। ভোর পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা । বোরখা পরা এক মহিলা ওই সময়ে বাচ্চা সহ ওখান দিয়ে যায় । কালও যাবে । অপারেশন কমপ্লিট হলেই আমাকে একটা কল করবে । ’
‘ ওকে বৌদি । আপনি যেমন চাইছেন । ’ চোখটা টিপে ফিক করে হাসলো বুম্বা । তারপর সামনে রাখা কাচের গ্লাসের জলটা গলায় চালান করে দিলো ।
* * * * * * * * *
খুব ভোরে রোহিণীর ফোনটা একটানা বাজতে থাকলে সকলের ঘুম ভেঙে গেলো । সবিতা উঠে এলেন বিছানা থেকে । গতরাতে বৌমা পুপুনকে নিয়ে গেস্টরুমে শুয়েছিলো । কিন্তু সেঘরে তো ফোন নেই । বৌমা বা পুপুনও নেই । বিছানা এলোমেলো । অন্য ঘরগুলিতে খুঁজতে লাগলেন । খোকার ঘর থেকে চিৎকার শুনতে পেলেন , ‘ মা ! মা ! রোহিণী কোথায় ? পুপুন ? ’
ততক্ষণে দেবোত্তম রোহিণীর ফোন হাতে নিয়ে ওর বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে । সব ঘর ভালো করে দেখে হতাশ হয়ে আশাও ছুটে এসে অবাক হয়ে জানতে চাইলো , ‘ তোমার হাতে বউদির ফোন ?’
সকলেই আবাক হয়ে দেখলো ফ্ল্যাটের বাইরের দরজাটি বন্ধ মনে হলেও আসলে খোলা । কলটিও কেটে গেলো ।
সমাপ্ত
© All rights reserved by Torkito Tarjoni