প্রাচীন তুরস্ক লোককথা – ভয়


ভাষান্তর শীর্ষেন্দু ভৌমিক শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের ইংরাজি বিভাগের অধ্যাপক। বর্তমানে আমেরিকার বৌদ্ধ ধর্মসংক্রান্ত সাহিত্য বিষয়ে একনিষ্ঠ গবেষণা করে চলেছেন। এর পাশাপাশি তিনি একজন সঙ্গীতশিল্পী, বাচিকশিল্পী তথা সাউন্ড এঞ্জিনিয়ার। তাঁর নিজস্ব YouTube চ্যানেল “Vale of Tales”–এ তাঁর নিজের পাঠকরা ও নির্মিত একাধিক গল্প আছে।
ভয়
অনেক অনেক কাল আগে এক গ্রামে বাস করত এক ছেলে ও তার মা। একদিন সন্ধ্যায় দুজনে ঘরের ভেতর বসেছিল। অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসতেই মা ছেলেকে বলল – “বাছা, দরজাটা একটু বন্ধ করে দিয়ে আয় নারে বাপ! আমার বড় ভয় করে!” ছেলে তো অবাক। সে মাকে শুধল, “ভয় কী গো মা?” মা বলল, “ভয় হল এমন এক জিনিস যা মানুষের মনে অস্বস্তি ও আতঙ্ক তৈরি করে।”
“কিন্তু ‘ভয়’ জিনিসটাই বা কী? তাকে দেখতে কেমন?”
মায়ের কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পেয়ে ছেলে বলল, “আচ্ছা বেশ, তোমায় আর কিছু বলতে হবে না। আমি নিজেই বাইরে গিয়ে খুঁজে দেখব ভয় কী বা তাকে দেখা যায় কিনা।”
আঁধারের মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল ছেলেটি। হাঁটতে হাঁটতে সে এসে উপস্থিত হল তার বাড়ির থেকে খানিক দূরের একটা ছোট পাহাড়ের উপর। সে দেখল চল্লিশ জন ডাকাত এক জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আগুন পোহাচ্ছে। ছেলেটি সোজা তাদের কাছে গিয়ে তাদের অভিবাদন জানাল। ডাকাতের সর্দার বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের ভয়ে এখানে কোনও কাকপক্ষী পর্যন্ত আসে না! তোমার এত সাহস যে তুমি এখানে নির্দ্বিধায় চলে এলে? বলো, কেন এসেছ এখানে?”
ছেলেটি বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে বলল, “আমি ভয় খুঁজছি। তোমাদের যদি জানা থাকে যে ভয় কোথায় পাওয়া যায়, তবে আমাকে অনুগ্রহ করে দেখাও।”
ডাকাতরা গর্বে বুক ফুলিয়ে বলল, “এ আর এমনকী কঠিন ব্যাপার? এখানেই ভয় আছে। আমরা যেখানে থাকি সেখানেই ভয় থাকে।”
“কোথায়?” জিজ্ঞেস করল ছেলেটি।
ডাকাত সর্দার এবার বললেন, “বেশ। এখান থেকে এই রান্নার পাত্র, কেটলি নাও। ওখানে থলের মধ্যে ময়দা, চর্বি, সবজি আর চিনি আছে। ওগুলোও নাও। তারপর ওই যে ওখানে কবরখানাটা দেখছো, ওখানে গিয়ে আমাদের জন্য হালুয়া বানিয়ে আনো।”
“বেশ, ঠিক আছে।” বলে ছেলেটি জিনিসপত্র নিয়ে কবরখানার দিকে চলে গেল ।
কবরখানায় ঢুকে একটা জুতসই জায়গায় বসে সে ভালো করে আগুন জ্বালল। তারপর সাথে আনা উপকরণ দিয়ে হালুয়া বানাতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সুস্বাদু হালুয়ার গন্ধে চারপাশ আমোদিত হয়ে উঠল। ওরা রান্না যখন প্রায় শেষ, তখন হঠাৎপাশের কবরটা থেকে বেরিয়ে এল একটা হাত। একটা অশরীরী কণ্ঠস্বরে কে যেন বলল, “আমি কি একটু ভাগ পাবো না?” ছেলেটা হাতের চামচটা দিয়ে হাতটার মধ্যে একটা বারি মেরে বলল, “হ্যাঁ রে আয় হতভাগা! জ্যান্ত মানুষ খেতে পাচ্ছে না, আর আমি সাধের খাবার মড়াকে খাইয়ে নষ্ট করি আর কী!? যা ভাগ্!”
হাতটা তৎক্ষণাৎ আবার কবরের মধ্যে ঢুকে গেল।
রান্নাবান্না শেষ করে হাঁড়ি ভর্তি হালুয়া নিয়ে ছেলেটি ফিরে এল ডাকাতদের কাছে। সর্দার জিজ্ঞাসা করলেন, “পেলে ভয়?” ছেলেটি নিরাশ গলায় বলল, “নাহ্! ভয় তো খুঁজে পেলাম না। শুধু কবর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে হালুয়া চাইল আর আমি সেটাকে মেরে তাড়িয়ে দিলাম।”
ডাকাতরা ভীষণ অবাক হল। এ কী ছেলেরা বাবা! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সর্দার বললেন, “এখান থেকে খুব কাছেই একটা খালি পোড়ো বাড়ি আছে। সেখানে গেলে তুমি ভয় পাবেই।”
এই শুনে ছেলেটা গেল সেই বাড়িতে। সেইখানে গিয়ে সে দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটা উঁচু বেদীর উপর একটা শিশুদের দোলনা টাঙানো। তার মধ্যে শুয়ে একটা ছোট্ট শিশু ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে চলেছে। আর অন্য দিকে একটা ছোট ছ-সাত বছরের কিশোরী মেয়ে সারা গরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে সে একছুটে ওর একেবারে কাছে এসে বলল, “আমাকে একটু তোমার কাঁধের উপর উঠতে দাও না গো! দাও না! আমার ছোট ভাইটা খুব কাঁদছে। কিন্তু আমি তো ছোট, তাই অত উপরে উঠে ওকে আদর করতে পারছি না। আমাকে কাঁধে নাও না গো!”
ছেলেটি এককথায় রাজি হয়ে গেল আর মেয়েটাও চড়ে বসল ওর কাঁধের উপর। কিন্তু ওমা, কাঁধে ওঠার পরেই দেখা গেল মেয়েটা ক্রমশ ওর পা দুটো দিয়ে ছেলেটার গলা চেপে ধরছে। শেষে তো ছেলেটার প্রায় শ্বাস আটকে যাবার জোগাড় হল। ছেলেটা আর থাকতে না পেরে এক মোক্ষম ঝাঁকুনি দিয়ে মেয়েটাকে নিজের কাঁধ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ছেলেটা অবাক হয়ে দেখল কেউ কোথথাও নেই। নিরজন, পোড়োবাড়ির মধ্যে সে একাকী দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটার হাত থেকে একটা ব্রেসলেট বা কবজি-বন্ধনী খুলে পড়েছিল মেঝের উপর। সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে ছেলেটা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে এমন সময় এক বুড়ো ইহুদীর সাথে দেখা। ছেলেটার হাতে ব্রেসলেটটা দেখেই বুড়োর চোখ লোভে চক্চক্ করে উঠল। সে বলে বসল, “এটা আমার।” ছেলেটা দৃঢ় ভাবে জবাব দিল, “মোটেই না। এটা আমার।”
“না, আমার।”
“না, এটা আমার।”
তর্কাতর্কি বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে উঠল। শেষে ছেলেটা বলল, “বেশ! তবে কাজীর কাছে চলো। সেখানেই বিচার হবে। তিনি যাকে এটা দেবেন, এটা সেই পাবে।”
কাজীর কাছে যাওয়া হল। সব শুনে কাজী বলল, “দুজনের মধ্যে যে আমাকে প্রমাণ দেখাতে পারবে, তাকেই আমি এইটা দেব। প্রমাণ করতে হবে যে এটা তোমার। তার আগে পর্যন্ত এটা আমার হেফাজতেই থাকবে।“
দুজনের কেউই কোনও প্রমাণ দেখাতে পারছে না দেখে কাজী বললেন, “এসব জিনিস কখনও একটা বিক্রি হয় না, জোড়ায় বিক্রি হয়। তাই যে আমাকে এর অপর জোড়াটা দেখাতে পারবে, তাকেই আমি প্রকৃত মালিক বলে ধরে নেব।”
এ কথা শোনার পর ছেলেটি আর বুড়োটি নিজের নিজের পথ ধরল। সমুদ্রের পারে এসে ছেলেটি দেখল, সমুদ্রের বুকে একটা বেশ বড়সড় জাহাজ ভয়ানক ভাবে নড়ছে। জাহাজের ভেতর থেকে বহু নরনারীর আর্তনাদ ভেসে আসছে। কোথাও কোনও ঝড় হচ্ছে না, অথচ জাহাজটা এভাবে কাঁপছে কেন? ছেলেটা পার থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “ওহে! তোমরা এভাবে চেঁচামেচি করছ কেন? তোমরা কি ‘ভয়’ পেয়েছ?” জাহাজ থেকে চিৎকার ভেসে এল, “ভাই, বাঁচাও! আমরা ডুবে যাচ্ছি।”
ছেলেটি তৎক্ষণাৎ গায়ের জোব্বা খুলে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর দ্রুত সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল জাহাজের দিকে। জাহাজের থেকে একটা দড়ি চেয়ে নিয়ে কোমরে বেঁধে ছেলেটা জলের গভীরে ডুব দিল। সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছে সে আবিষ্কার করল যে সমুদ্র দেবের দস্যি মেয়ে দানীজ় কিজ়ি খেলার ছলে জাহাজটাকে তলা থেকে ধরে প্রবল বেগে নাড়াচ্ছে আর তাতেই জাহাজের তথৈবচ অবস্থা।
ছেলেটার হাতে একটা সরু কঞ্চি ছিল। সেটা দিয়ে সে দানীজ় কিজ়িকে বেদম প্রহার করল। শেষে ভয় পেয়ে মেয়েটা পালাল। জল থেকে উপরে উঠে ছেলেটা জাহাজের লোকদের বলল, “তোমরা বললে ভয় পেয়েছ! কোথায় ভয়? ওটা তো একটা বাচ্ছা মেয়ে!”
হাঁটতে হাঁটতে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পথের প্রান্তে একটা বাগানের ধারে বসল ছেলেটা। বাগানটা খুব সুন্দর। কিছু সময়ের পর ও বাগানের একটু ভিতরে গাছের ছায়ায় এসে বসল। সামনেই একটা সুন্দর ঝরনা। ও অবাক হয়ে দেখল তিনটে সাদা পায়রা এসে ঝুপ্ঝুপ্ করে সেই ঝরনার জলে ডুব দিল। কিন্তু ডুব দেওয়ার পর যখন তারা উঠে এল, তখন তারা আর পায়রা নেই। তিন জনেই পরিণত হয়েছে তিন পরমা সুন্দরী কন্যায়।
মেয়ে তিনটি এবার টেবিল পেতে খেতে বসল। টেবিলে নানা সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয় এনে রাখা হল। প্রথম মেয়েটি যেই পানপাত্র ঠোঁটের কাছে ধরল, তখন বাকিরা তাকে জিজ্ঞেস করল, “কার উদ্দেশ্যে পান করছ, সখী?” মেয়েটি জবাব দিল, “আমি সেই যুবকের উদ্দেশে পান করব যে রাতের বেলায় কবরের কাছে হালুয়া বানাচ্ছিল, এবং এক অশরীরীর হাত দেখেও যে একটুও ভয় পায় নি।” দ্বিতীয় জন পান করতে যেতেই বাকিরা প্রশ্ন করল, “তুমি কার উদ্দেশ্যে পান করছ, সখী?” মেয়েটি বলল, “আমিও একজন নির্ভীক যুবকের উদ্দেশ্যে পান করব। সেদিন রাতে পোড়োবাড়িতে আমি তার কাঁধে চেপে বসে প্রায় তার শ্বাস রোধ করে ফেলেছিলাম। তবুও সে এতটুকু ভয় পায় নি।” তৃতীয় জনকে যখন প্রশ্ন করা হল যে সে কার উদ্দেশ্যে পান করছে, তখন মিষ্টি হেসে সে বলল, “সমুদ্রের বুকে, নেহাত খেলার ছলে, আমি একটা বিরাট জাহাজকে তলার দিক থেকে ধরে আন্দোলিত করছিলাম। জাহাজটা এমন নড়ছিল যে জাহাজের যাত্রীরা প্রাণভয়ে আর্তনাদ করছিল। ঠিক তখনই কোথা থেকে এক যুবক এসে আমাকে এমন কঞ্চিপেটা করল যে আর একটু হলে আমি মরেই যেতাম। সেই নির্ভীক যুবকের উদ্দেশে আমি পান করব।”
সকলের কথাবার্তা শুনে ছেলেটি এবার হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলল- “তোমরা সকলে বোধহয় আমার কথাই আলোচনা করছ। আমিই সেই যুবক।”
সকলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছেলেটিকে কাছে টেনে নিল। তাকে খুব খাতির-যত্ন করল। ছেলেটি এবার বিনীত ভাবে বলল, “তোমাদের একটা ব্রেসলেট আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু একটা ইহুদী বুড়ো চেষ্টা করছিল আমার থেকে সেটা কেড়ে নিতে। আমি সেটা দিতে অস্বীকার করি। শেষে কাজীর কাছে যেতে হয়। তো কাজী বলেছেন ওটার জোড়াটা দেখাতে পারলে তবেই ওটা আমাকে ফেরত দেবেন।”
এই কথা শুনে মেয়েরা তাকে এক বিরাট গুহার ভেতরে নিয়ে গেল। সোনা-দানা, হীরে-জহরত, মোহর কী নেই সেখানে!? ছেলেটির তো পুরো চক্ষু চড়কগাছ হবার জোগাড়। মেয়েরা তাকে ব্রেসলেটের আরেকটি জোড়া দিল। সেটা নিয়েই ছেলেটি তৎক্ষণাৎ কাজীর কাছে গিয়ে ব্রেসলেটটা ছাড়িয়ে নিয়ে ফিরে এল। এবং সেগুলো দ্বিতীয় মেয়েটিকে ফেরত দিয়ে দিল।
মেয়েরা খুব খুশি হয়ে তাকে বলল, “তুমি আমাদের কাছেই থেকে যাও। তোমায় আর কোথাও যেতে হবে না।”
ছেলেটি হেসে বলল, “সেটা হলে তো খুবই ভালো হত। কিন্তু আমি যতদিন না ‘ভয়’ খুঁজে বার করতে পারছি, ততদিন আমার বিশ্রাম নেই।”
অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ছেলেটি সেখানে থাকতে রাজি হল না।
এবার হাঁটতে হাঁততে একটা জায়গায় এসে সে দেখল, সেখানে অনেক লোকের ভিড়। সে একজনকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, এখানে কী হচ্ছে? এখানে এত ভিড় কেন?” লোকটি জানাল যে দেশের সম্রাট হঠাৎ মারা গেছেন। তাই এখানে পায়রা ওড়ানো হচ্ছে। সে পায়রা উড়ে গিয়ে যার মাথায় বসবে, তিনিই পরবর্তী সম্রাট বলে বিবেচিত হবেন। সেই কাণ্ড স্বচক্ষে দেখবে বলেই এত লোক জড়ো হয়েছে।
কথাটা শুনে ছেলেটির বেশ কৌতুহল হল। সে-ও ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগল। পায়রা ওড়ানো হল। সেটা হাওয়ার মধ্যে একপাক উড়ে সোজা উড়ে এসে বসল ছেলেটার মাথায়! সাথে সাথে সকলে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। কিন্তু ছেলেটি ঘোর আপত্তি জানাল। সে বলল, “আরে ভাই, আমি গরীব ঘরের সাধারণ ছেলে। আমি কীকরে রাজা হব? আর তাছাড়া আমার অন্য কাজ আছে। আমি ‘ভয়’ খুঁজতে বেরিয়েছি।”
এ কথা শুনে আবারও নতুন করে পায়রা ওড়ানো হল। কিন্তু এবারেও পায়রা এসে বসল সে-ই ছেলেটিরই মাথায়। পরপর তিনবার পায়রা উড়িয়ে যখন একই ঘটনা ঘটল, তখন সকলে ছেলেটিকে চেপে ধরল। বলল, “এবার তো দয়া করে মেনে নিন যে আপনিই আমাদের শাহ-সুলতান, আমাদের সম্রাট।”
ছেলেটির কোনও আপত্তি আর ধোপে টিকল না। সকলে মিলে তাকে কাঁধে করে নিয়ে এল প্রাসাদে। সম্রাটের বিধবা স্ত্রীর সাথে তার সাক্ষাৎ হল। তাকেও নিজের কথা খুলে বলল সে। সব শুনে সম্রাজ্ঞী বললেন, “অন্তত আজ রাতের জন্য আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করুন। আগামীকাল আমি আপনাকে ‘ভয়’ দেখাব।”
এই কথা শুনে ছেলেটি শেষমেষ রাজি হয়ে গেল। কিন্তু ছোট থেকে একটা প্রচলিত প্রবাদ সে শুনে এসেছে – “যিনি আজকে রাতে রাজন/ তিনি সকালে পরবেন কাফন!” অর্থাৎ আজ রাতে যদি তুমি সম্রাট হও, তবে পরদিন সকালেই তুমি পরিণত হবে এক প্রাণহীন মৃতদেহে। এদিকে প্রাসাদের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে একটা ঘরে এসে উপস্থিত হল। সেখানে সে দেখল, তার জন্য কফিন বানানো হচ্ছে! মনের মধ্যে চরম অস্বস্তি উপস্থিত হল তার। কিন্তু মুখে কোনও প্রকার কোনও উচ্চবাচ্য না করে সেদিন রাতে সে চুপচাপ নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর মাঝরাতে চুপিচুপি উঠে সেই ঘরে গিয়ে কফিনটাকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলল। একাজ করার পর তার মন শান্ত হল। বাকি রাতটা সে নিশ্চিন্তে ঘুমাল।
যে প্রবাদ বাক্যটা শুনে ছেলেটি বড় হয়েছে, সেটা কিন্তু আসলে আক্ষরিক অর্থেই এতকাল সত্যি ছিল।
আগের রাতে যিনি সম্রাট হতেন তিনি কোনও অজ্ঞাত কারণেই পরদিন সকালে মারা যেতেন। এদিন সকাল হতেই ভৃত্যরা এল নতুন শাহের মৃতদেহ নিতে। ঘরে এসে তাঁকে জীবন্ত ও সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দেখে তাদের আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। ছুটে গিয়ে তারা সম্রাজ্ঞীকে এই খুশির খবর দিল। সম্রাজ্ঞী এবার রাঁধুনিকে ডেকে আদেশ দিলেন, “আজ যখন রাতের খাবার পরিবেশন করবে, তখন নতুন শাহের সুপের পাত্রে একটা জীবন্ত চড়াই পাখি রেখে দেবে।”
সন্ধ্যে হল। নবীন শাহ ও সম্রাজ্ঞী নৈশাহারে বসলেন। সুপের বাটি আসতেই সম্রাজ্ঞী বললেন, “ওই বাটির উপরের ঢাকনাটা তুলুন।” ছেলেতি বিনীত ভাবে বলল, “আজ্ঞে না, ধন্যবাদ। আমি সুপ খাই না।”
“আরে, তাও একবার ঢাকনাটা খুলে তো দেখুন।”
সম্রাজ্ঞীর অনুরোধে ছেলেটি হাত বাড়িয়ে ঢাকনা খুলতেই বাটি থেকে ফুড়ুৎ করে পাখি বেড়িয়ে এল।
ঘটনাটা এতটাই অতর্কিতে ঘটল যে ছেলেটি ভয়ানক ভাবে চমকে উঠল। সম্রাজ্ঞী হেসে উঠলেন। বললেন, “দেখলেন তো? এই হল ‘ভয়’!”
ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, “তাই বুঝি?”
সম্রাজ্ঞী হেসে বললেন, “হ্যাঁ! আর তাছাড়া নিজের কফিন তৈরি হতে দেখে আপনার মনে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় নি?”
“হ্যাঁ, একটু অদ্ভুত অস্বস্তি হয়েছিল।”
“ওটাই ভয়!”
এরপর দেশের নিয়ম অনুযায়ী নতুন সম্রাটের সাথে সম্রাজ্ঞীর বিয়ে হল। সেই বিয়ের ভোজসভা চলল চল্লিশ দিন ও রাত ধরে। নতুন সম্রাট তাঁর মাকেও প্রাসাদে নিয়ে এলেন। সকলে মিলে তাঁরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন।
ঋণ স্বীকার – http://www.academia.edu
© All rights reserved by Torkito Tarjoni
👌👌