আলোকচিত্রের ভাষা ও শিল্প


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। কর্ম জীবন শুরু হয়েছিল অভিনয়ের হাত ধরে থিয়েটারে। ফটোগ্রাফি চর্চার প্রতি অদম্য ভালোবাসা ছিল ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু এই চর্চাকে কখনোই জীবন জীবিকা হিসেবে দেখেনি বরং পরবর্তীতে অভিনয় থেকে কর্মজীবন প্রতিস্থাপিত হয়েছিল চিত্র পরিচালনায় এবং চিত্রনাট্য রচনায়। দীর্ঘ ২০ বছর টেলি ছবি, ছোট ছবি এবং দৈনিক ধারাবাহিক পরিচালনার এবং সিনেমা চর্চার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত।
বাস্তবতা আমাকে আলোড়িত করে। তার প্রকাশের ভাষা আমার কাছে আলোকচিত্র। ছেলেবেলা থেকেই চলতে চলতে বুঝে গিয়েছি আলোকচিত্র শুধু মাত্র ছবি তোলার একটা কৌশলগত প্রক্রিয়া নয়, এ আমার কন্ঠস্বর।
বস্তুত প্রয়োজনে ফটোগ্রাফি যে কন্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে সেটা আমাকে বুঝিয়েছিল বাবা। বলেছিল যে আলোকচিত্রের মধ্যে দিয়ে ছবি আঁকাও সম্ভব। সে ক্ষেত্রে হাতে রঙ তুলির প্রয়োজন নেই। ক্যামেরাটাই যথেষ্ট। আলোকচিত্রও তাই চারুকলার পর্যায়ভুক্ত। তবে ওই সময়ে বাবার ব্যাখ্যা অতটা প্রাঞ্জল ছিল না আমার কাছে। পরবর্তীতে যখন বুঝতে শিখলাম বাবার কথার মর্মোদ্ধার করে উঠতে পেরেছিলাম। বিশ্বাস করেছিলাম আলোকচিত্র যথার্থই একটি শিল্পকলা।
আলোকচিত্র কেন একটি শিল্প কলার সমপর্যায়ভুক্ত হবে এই নিয়ে বিস্তর তর্ক এবং মতবিরোধ রয়েছে। তার চুলচেরা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় যাব না এখন। বরং ব্যক্তিগত স্তরে যে বিশ্বাস থেকে ফটোগ্রাফিকে একটি সৃজনশীল শিল্প হিসেবে দেখি, তার কথা বলব।
শৈশব আর কৈশোরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি তখন। যা কিছু নতুন দেখি তাই নিয়েই অপার কৌতুহল তৈরি হতে শুরু করেছে। প্রশ্নের অভিঘাতে মাঝে মধ্যে আমার চারপাশে থাকা মানুষজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছি তবুও প্রশ্নের খামতি নেই। এর মাঝেই একদিন আমার হাতে উঠে এল বিশেষ ভাবে ছোটদের জন্য তৈরি একটা ক্যামেরা। ‘আগফা’ কোম্পানির তৈরি ছিল সেই ক্যামেরা। এর পিছনে একটা ঘটনা আছে। সেই ঘটনা থেকেই এই বিশ্বাস আমার মনে দানা বাঁধতে শুরু করে।
আমার বয়স তখন আট কি নয় বছর। দিল্লী থেকে অফিসিয়াল ট্যুর সেরে বাবা ফিরেছে বাড়িতে। দরজা খুলতেই দেখি একটা নতুন ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে বাবা। নতুন কারণ আমাদের বাড়িতে কোনও ক্যামেরা ছিল না। ইতিপূর্বে ক্যামেরায় যে ছবি তোলা হয় তা জেনে গিয়েছিলাম। মামার বাড়িতে একটা ভিনটেজ বক্স ক্যামেরা ছিল। ছবি তোলা যেত না তবুও গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। ফলে বাবার হাতে ক্যামেরা দেখে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত আমি। বর্তমান সময়ের ডিজিটাল কম্প্যাক্ট ক্যামেরা ছিল না সেটা। একটা ফিক্সড লেন্স ছিল। ম্যানুয়াল অ্যাপারচার, তবে শাটার স্পিড আর ফিল্ম স্পিড পুরোটাই ছিল অটো মোডে। ছবি উঠত সাদা কালো।
আমার দাদা অসাধারণ ছবি আঁকত। আমি পারতাম না। এই না পারার জন্য একটা চাপা দুঃখবোধ মনের ভিতরে ছিল। বাবা জানত আমার মনের সেই আক্ষেপ। তাই হাতে ক্যামেরাটা দিয়ে বাবা প্রথমেই বলেছিল, ‘আজ থেকে রঙ তুলি নয় তুই এই ক্যামেরাতেই ছবি আঁকিস।’ স্বাভাবিকভাবেই আমি তো অবাক। ক্যামেরায় আবার ছবি আঁকা সম্ভব নাকি! কী করে আঁকব! ক্যামেরা তো রঙ তুলি নয়! ক্যামেরা তো যন্ত্র!
ঠিক কথা। চিত্রাঙ্কনে শিল্পীর যে ভাব প্রকাশ পায় সেটা কী শাটার টিপে হয় নাকি! ক্যামেরা তো বাস্তব মুহূর্তকে মূর্ত করে, চিরস্থায়ী করে রাখে। সেখানে সৃজনশীলতার অবকাশ কোথায়?
বাবা বুঝিয়েছিল শান্ত হয়ে। একজন মাস্টার পেইন্টার, মানুষের জীবন মৃত্যুর চূড়ান্ত বাস্তবধর্মী ছবি আঁকছেন। আর ক্যামেরা সেই বাস্তবের হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করছে। তাহলে তফাতটা কোথায়? পরে বুঝেছিলাম আলোকচিত্রই হোক বা হাতে আঁকা ছবি তফাৎ গড়ে ওঠে শিল্পীর মননে, বোধে, চেতনায়। একই ছবি এক এক জন শিল্পীর হাতে এক এক রকম ব্যঞ্জনায় প্রকাশ পায়। আর এই ব্যঞ্জনা নির্মাণ হয় তার মনে, বোধে, তার দেখার চোখে।
চিত্র এবং আলোকচিত্রের মধ্যে প্রথম থেকেই একটা মৌলিক ঐক্য রয়ে গেছে। উভয়েরই উদ্দেশ্য একটি সীমাবদ্ধ জ্যামিতিক পরিসরকে আলোর সাহায্যে সাজিয়ে তোলা। যাকে ইংরেজিতে আমরা কম্পোজিশন বলে থাকি। সার্থক সৃজনশীলধর্মী আলোকচিত্র প্রতিনিয়ত ওই কম্পোজিশনের বৈভবে নান্দনিকতায় অভিষিক্ত হচ্ছে ।
আলোকচিত্রকে প্রথম থেকেই সময়ের আয়না বলে অভিহিত করা হয়ে এসেছে। যথার্থই তাই। সে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। তার ফলে চিত্রাঙ্কন নয় এই আলোকচিত্র নির্মাণের কৌশল আর প্রকরণে বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দিয়েছে।
১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সের জোসেফ নিপসে যখন প্রথম এই আলোকচিত্র নির্মাণ নিয়ে ক্যামেরা অবস্কিউরায় পরীক্ষা করেছিলেন তখন আলাপ হয় শিল্পী লুই ডাগুয়েরের সঙ্গে। এক সঙ্গে মিলে চেষ্টা চালিয়ে যান ফটোগ্রাফি পদ্ধতি আবিষ্কারের। ১৮৩৩ সালে নিপসের মৃত্যুর পর তাঁর অংশীদার লুই ডাগুয়েরে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। এবং ১৮৩৭ সালে প্রথম আলোকচিত্র নির্মাণের যথাযথ প্রয়োগ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৮৩৯ সাল ফ্রান্স সরকার এর পেটেন্ট কিনে নেন ডাগুয়েরের থেকে । সেই ডাগুয়েরের টাইপ ফটোগ্রাফির সূচনা পর্ব থেকে আজ এই ডিজিটাল যুগে প্রতি সেকেন্ডে বহু মানুষ ছবি তুলছে।
প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত অনন্ত দৃশ্যমালা উৎসারিত হয়ে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। তার মধ্যে হঠাৎ-ই এমন এমন দৃশ্যের জন্ম হয় যার মধ্যে থাকে আকস্মিকতা, অনন্যতা, বিস্ময়। ফটোগ্রাফির ভাষায় সেই অপ্রত্যাশিত নাটকীয় মুহূর্তকে বলে ‘Decisive Moment’। আলোকচিত্র শিল্পী সেই বিরল মুহূর্তটিকেই ছবিতে ধরে রাখে, ঠিক যেমন একজন চিত্রকর রঙ তুলির আঁচড়ে তাকে মূর্ত করে। আর এখানেই মুন্সিয়ানা। মননের উৎকর্ষতা যখন সার্থকতার সঙ্গে প্রতিভাত হয় তখনই সেই নির্মাণ সৃজনশীল নান্দনিক হয়ে ওঠে।
দৃশ্যকলা প্রকৃতিগত ভাবে বাস্তব হয় না কখনো, যতই যথার্থ প্রতিলিপি হোক না কেন। বরং বলা যায় , প্রকৃতির সমান্তরালে স্বতন্ত্র এক বাস্তব নির্মাণ হয়ে থাকে। যে নির্মাণের মধ্যে দিয়ে সত্যের নানান মাত্রা আর আভাসকে অনুধাবন করতে চায় একজন শিল্পী। শুধু রঙ নয় আলোকচিত্রে বর্ণের বৈচিত্র্যকে পরিহার করে বর্ণের দুটি চরম প্রান্ত সাদা এবং কালোকে যখন আশ্রয় করেন শিল্পী তখন তিনি যথার্থই প্রাকৃতিক বাস্তব থেকে সরে আসেন। সাদা হলো পূর্ণ আলোকময়তা আর পূর্ণ আঁধারের প্রতিনিধি কালো রঙ। এই দুইয়ের মধ্যে থাকে ধূসর অন্তহীন স্তর। শিল্পী জানেন ধূসরের এই বিস্তীর্ণ মাত্রাকে ব্যবহার করতে পারলে নানাবিধ রহস্যের উদ্ঘাটন সম্ভব। সুতরাং আলোকচিত্রের এই প্রয়োগ এবং কলা-কৌশল চারুশিল্পের সমপর্যায়ভুক্ত কেন হবে না?
বর্তমান সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির হাত ধরে আধুনিক ফটোগ্রাফিতে নানা বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। মূর্ত থেকে বিমূর্তের অনেকগুলো স্তর নিয়ে কাজ হয় এখন। অনেক শিল্পীই আছেন বর্তমান সময়ে যারা ক্যামেরাকে ব্যবহার করেন রঙ তুলির বিকল্পে। তাঁদের হাতে আলোকচিত্র পরিপূর্ণ রুপে চিত্রপ্রতিম। আপাত বাস্তবতাও বহু শিল্পীর চোখে তার অন্তরলোকে নিহিত রহস্য উন্মোচিত করে।
জার্মান দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট বলেছিলেন, ‘Objects are unknowable apart from their representation’ – রূপায়ণ ছাড়া বাস্তবকে জানা যায় না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ’। ঠিক এই বিশ্বাসেই উত্তর-আধুনিক আলোকচিত্র থেকে বাস্তবের আবরণ দূরীভূত হতে দেখা গেল। ফটোগ্রাফিকে এই জায়গা থেকে যারা এক স্বতন্ত্র শিল্পসত্তায় উদ্ভাসিত করলেন তাঁরা হলেন জাঁ বড্রিলার্ড, ভ্যান এলক, বয়েড ওয়েব, সিনডি শেরম্যান, সেবাস্তিয়ান সালগাদর, সেরি লেভিন, ভিক্টর বারজিন, সোফি কালে প্রমুখ আলোকচিত্র শিল্পীরা। তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে বাস্তবতা, সামাজিকতা, রাজনীতি, নারীবাদ, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, ধনতন্ত্রের নিষ্পেষণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্নের অবতারণা এবং উত্তর খোঁজার নানাবিধ ছবি উঠে এল।
এতদসত্ত্বেও যেহেতু ‘মেকানিকাল রিপ্রোডাকশন’ বলে একাধিক প্রতিলিপি তৈরি করা যায়, তাই চিত্রশিল্পের মত আলোকচিত্রের অনন্যতা এখনো স্বীকৃত হচ্ছে না আজও। তথাপি বর্তমানে আলোকচিত্রকে শিল্প হিসেবে ব্রাত্য করে রাখা যাচ্ছে না। একটা নিজস্ব নান্দনিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে ফটোগ্রাফি। আজ যাকে ‘অলটারনেটিভ আর্ট’ বা ‘কাটিং আর্ট’ বলা হয় সেই ক্ষেত্রে আলোকচিত্র ও চিত্র শিল্পের মধ্যে বিশেষ কোন ব্যবধান নেই। আজ এই দুটি মাধ্যম তাদের স্বাতন্ত্র্যর মধ্যেও পরস্পর পরস্পরের সহযোগী ও পরিপূরক।
© All rights reserved by Torkito Tarjoni
লেখা, ছবি, তথ্য…সাথে স্মৃতিচারণ মিলেমিশে মনোগ্রাহী উপস্থাপনা। খুব ভালো লাগল।